সুশীলের সঙ্গে বটুকেশ্বরের আর দেখা হয় নি। যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল তেমন নিঃশব্দেই সে চলে গেছে কলকাতায়। বটুককে আর কিছু করতে হল না। ওর বাবাই গিয়ে একদিন ওর নাম কাটিয়ে আনলেন ব্রজমোহন কলেজ থেকে। ছেলে ছবি আঁকা শিখতে চায়, তাই শিখুক। বরিশালে থাকলে শেষে কি বোমা-পিস্তলের দলে ভিড়বে। স্বদেশী করার চেয়ে ছবি আঁকা ভাল–অন্তত দীননাথ দেবনাথের পাটোয়ারী বুদ্ধি তাই বলে।
এক বছর বরিশালে কাটিয়ে বটুকেশ্বর দেবনাথ ফিরে এল কলকাতায়। ভর্তি হল সরকারী আর্টস স্কুলে। উনিশ-শ ছয় সালে। রজনীকান্ত গুহর অগ্নিস্রাবী রাজনীতির প্রখর রৌদ্র থেকে অবনীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধ শিল্পচ্ছায়ায়। মাত্র এক বছর হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ছেলে অবনীন্দ্রনাথ সরকারী আর্টস স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষরূপে কর্মভার বুঝে নিয়েছেন।
.
০৪.
কিন্তু চন্দ্রভান? সে কি সত্যিই সন্ন্যাসী হয়ে গেল নাকি?
চন্দ্রভানের কাহিনী বলতে গেলে একটু আগে থেকে শুরু করতে হবে।
জমিদার বাড়ির ছেলে চন্দ্রভান একটু অদ্ভুত ধরনের ছেলে ব্রাবরই। ওর চরিত্রের মূলে ছিল। একটা দুরন্ত অভিমান। এ অভিমানটা ঠিক কার প্রতি তা বলে বোঝানো যাবে না। তবে আঘাতটা কেমন করে এসেছিল তার একটা হদিস পাওয়া যায়।
আট বছর বয়সে মাতৃবিয়োগে ওর বালক মনে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছিল। কিন্তু তার চেয়েও আঘাত পেয়েছিল কাকা কাকীমার ব্যবহারে। সম্পত্তির এই দুই ভাগীদারকে তারা বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাদের সোনার চাঁদ ছেলেদের প্রাপ্যে ভাগ বসাতেই আছে ওরা দুজন। কাকা কাকীমার উদাসীনতার আইসবার্গ আর পাঁচজনের নজরে পড়ে নি, কিন্তু চন্দ্রভান তার শিশুমন নিয়েই বুঝতে পেরেছিল ঐ নিরুত্তাপ ভাসমান আইসবার্গের নিচে নিমজ্জিত হয়ে আছে বহুগুণ ঘৃণা আর বিদ্বেষ! শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে নিল চন্দ্রভান, আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল মা-হারা ভাই সূরযকে। প্রাণধারণের জৈবিক বৃত্তিতেই বোধকরি শিশু বুঝতে পারে কোথায় পাওয়া যাবে স্নেহ-ভালবাসা। সূরযভান নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল তার দাদাকে। দাদাই তাকে জামা পরিয়ে দেয়, জুতো পরিয়ে দেয়–দাদাই তাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ায় বনে বাদাড়ে। অগ্নিভান কি বুঝলেন তা তিনিই জানেন। দু-ভাইকে সরিয়ে ফেললেন জমিদার বাড়ি থেকে। কলকাতার বাড়িতে এনে রাখলেন ওদের, গৃহ-শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। ফলে, যে বয়সে মায়ের স্নেহ আর বাপের ভালবাসা শিশুরা জীবনরস সংগ্রহ করে সেই বয়সে ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল। মজা হচ্ছে এই যে, চার পাঁচ বছরের ভিতরেই ওদের ভূমিকাটা গেল বদলে। সূরযভান বয়সে ছোট হলেও সাধারণ বুদ্ধি তার বেশী। সেই হয়ে উঠল চন্দ্রভানের অভিভাবক। দাদার জামাকাপড়ের হিসাব পর্যন্ত রাখত সে।
অগ্নিভান সূরযকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু কিছুতেই রাজী করাতে পারে নি সূরযভানকে। দাদাকে ছেড়ে সে থাকবে না। শেষ পর্যন্ত অগ্নিভান মাসান্তে ওদের নামে টাকা পাঠানো ছাড়া ওদের সম্পর্কই ভুলে যেতে বসেছিল।
হঠাৎ নাটকীয়ভাবে একটা কাণ্ড ঘটে গেল একদিন। একদিন নয়, সে একটা চিহ্নিত তারিখ ইতিহাসের পাতায়। উনিশ-শ পাঁচের সেই ষোলোই অক্টোবর-ত্রিশে আশ্বিন। বড়লাট লর্ড কার্জনের হুকুমজারী করেছেন, ঐদিন বাঙলা মায়ের অঙ্গ কেটে দুখানা করা হবে। পূব বাঙলা আর আসামের লাট হবেন ব্যামফিল্ড ফুলার। কলকাতা টাউন হলে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে বাঙলার সুধীজন জানালেন প্রতিবাদ। তারপর ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মৈমনসিঙ, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি বাঙলার এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে ক্রমাগত প্রতিবাদ সভা হল। ডন পত্রিকায় সতীশচন্দ্র তীব্র প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু ক্ষমতামদমত্ত শাসকশ্রেণী কর্ণপাত করল না। তারা অচল রইল তাদের সিদ্ধান্তে ঐ ত্রিশে আশ্বিনই বাঙলাকে কেটে দু টুকরো করা হবে।
তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ল সমস্ত দেশ। এ-পার বাঙলা ও-পার বাঙলা। বাঙলার কবি বললেন–এ দিন রাখীবন্ধন উৎসব হবে। রামেন্দ্রসুন্দর বললেন–ঐ সঙ্গে অরন্ধন। সমস্ত দিনের মত কর্মসূচী তৈরী হয়ে গেল। আর্যমিশনেও এসে লাগল ঢেউ। চন্দ্রভান অবশ্য তখন ঐ স্কুলের ছাত্র নয়। পাস করে ইতিমধ্যে মিশন কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সূরয তখনও ঐ স্কুলের ছাত্র। চন্দ্রভান, সূরয, গগন, দ্বৈপায়ন আর সুশীল ভোর বেলায় এসে জড়ো হল স্কুলের মাঠে। সমস্ত দিনের মত ওদের কর্মসূচী তৈরী হয়ে আছে। সূর্যোদয়ের আগে থেকেই দলে দলে সারা কলকাতার মানুষ চলেছে। গঙ্গার ধারে। ওরাও কজন গিয়ে স্নান করল গঙ্গায়। তারপর দল বেঁধে সবাই চলল বিডন উদ্যানে আর সেন্ট্রাল কলেজ প্রাঙ্গণে। সেখানে হল রাখীবন্ধন উৎসব।
সারা শহরে সেদিন অরন্ধন। কোন বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে নি। দোকান-পাট হাট বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ। পথে পাল্কি, ঘোড়ার গাড়ি বা গোরুর গাড়ি চলছে না। শুধু পদাতিক। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। শুধু বন্দেমাতরম্। গান গাইছে কোন কোন শোভাযাত্রী ছেলের দল—
বাঙলার মাটি, বাঙলার জল, বাঙলার বায়ু, বাঙলার ফল,
–পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
সে কী গান! কে বাঁধল গো এমন গান? কে আবার? জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কবি রবীন্দ্রনাথ। আবার কেউ গাইছে–ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টুটবে।