অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী উৎসাহে উঠে দাঁড়ান। বলেন, –ডক্টর! আমাকে নিয়ে চলুন সেখানে। ও-ছবি নিয়ে আসা যাবে না । কিন্তু আমার কাছে কালার্ড ফিল্ম আছে। প্রতিটি দেওয়ালের
বাধা দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন, আমি দুঃখিত প্রফেসর। সে ছবি নেই।
–নেই! কেন? কি হল ঘরখানার?
ডাক্তার সাহেব তার শেষ দিনের অভিজ্ঞতা বলতে থাকেন। য়ামায়াকে তিনি সভ্য দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন সঙ্গে করে। মেয়েটি রাজী হয়নি। বলেছিল, সে পরে আসবে। তার বুঝি কী একটা কাজ ওখানে বাকি আছে। কী কাজ, জানতে চেয়েছিলেন ডাক্তার-সাহেব। জবাবে য়ামায়া বলেছিল–ঘরখানা জ্বালিয়ে দিতে হবে!
মৃত্যুর পূর্বে গগন নাকি য়ামায়াকে নির্দেশ দিয়ে যায়–তার জিনিস কাপড়, রঙ, তুলি, ছবি সব কিছু ঐ ঘরখানায় ভরে যেন তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কুষ্ঠব্যাধির বীজের যেন কোন অবশেষ না থাকে। ডাক্তার সাহেব য়ামায়াকে বারণ করলেন। ছবির কিছু না বুঝলেও উনি এটুকু বুঝেছিলেন যে, এ এক অদ্ভুত সৃষ্টি। কিছু ফটো তুলে রাখার কথা তার মনে হয়েছিল। সেকথা তিনি জানিয়েছিলেন জঙলি মেয়েটিকে। বলেছিলেন আমি নিজে ডাক্তার, এ রোগের সংক্রামতার কথা আমার চেয়ে কেউ বেশি বোঝে না। আমি বারণ করছি। দু-চারদিন পরেই আমি ফিরে আসব, দুদশখানা ফটো নেব। তারপর আমি নিজেই জ্বালিয়ে দিয়ে যাব।
য়ামায়া চুপ করে অবসন্নের মতো বসে রইল। হা-না কিছুই বলল না। অগত্যা একাই ফিরে চললেন ডাক্তার সাহেব। আধখানা পথও আসেননি–হঠাৎ দেখতে পেলেন পাহাড়ের মাথায় আগুন লেগেছে। আবার চড়াই ভেঙে উপরে উঠে গেলেন। দেখেন, প্রভুভক্ত কুকুরীর মত য়ামায়া তার মরদের শেষ আদেশ পালন করেছে নিঃশব্দে। পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরখানা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত!
…একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরীর।
ডাক্তার ওয়াটকিন্স তার দীর্ঘ কাহিনী শেষ করে একটা চুরুট ধরান। বলেন, –শিল্পীর ছবিখানা আমি আমার চেম্বারেই টাঙিয়ে রেখেছি। আচ্ছা, প্রফেসর! গগন পাল কি সত্যিই একজন প্রতিভাধর শিল্পী? এ ছবিখানি আমি যদি বিক্রি করতে চাই তার খদ্দের হবে?
প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরীও তার পাইপ ধরাতে ব্যস্ত ছিলেন। বলেন, -হবে। খদ্দের আপনার সামনে উপিস্থত। ছবিখানা আমি কিনব। কত দাম নেবেন?
ডাক্তার সাহেব ইতস্ততঃ করে বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, ছবির কী রকম দাম হয় আমার কোন ধারণা নেই। আপনি যা ন্যায্য মনে করুন, দিন।
–বেশ। তাই দিচ্ছি আমি। একটু হিসাব কষি তাহলে। আগে বলুন, আপনি সারাদিনের জন্য দূর গ্রামে রুগী দেখতে গেলে কত ভিজিট নেন?
–একথা কেন?
বলুনই না!
দশ ডলার।
অধ্যাপক তার বুক-পকেট থেকে ভারি ওয়ালেটটা বার করে বলেন, আপনি তিনবার শিল্পী গগন পালকে দেখতে গিয়েছিলেন। সুতরাং ত্রিশ ডলার আপনার প্রাপ্য। আপনি নিজেই বলেছেন যে, শিল্পী আপনাকে বলেছিলেন–গরীবের যে আত্মসম্মান জ্ঞান থাকবে না এমন কোন কথা নেই
–আপনি কি পুরো ত্রিশ ডলার দাম দিতে চান? ঐ সামান্য ছবিটার?
না। তাহলে শিল্পী গগন পাল হবেন মিথ্যাবাদী, আর আমি জোচ্চোর।
তার মানে?
–শিল্পী আপনাকে আরও বলেছিলেন–এ ছবি ভবিষ্যতে আপনার ভিজিটের শতগুণ আপনাকে দেবে। এই নিন–তিন হাজার ডলার ।
ডক্টর ওয়াটকিন্স জবাবে কি বলেছিলেন তা আর বলেননি অধ্যাপক। দ্বৈপায়ন-দাদুকে শুধু বলেছিলেন, ডক্টর লাহিড়ী! আপনি জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বাড়ি-গাড়ি-পশার প্রতিপত্তি সবই হয়েছে। তবু কিছু মনে করবেন না–আজ থেকে একশো বছর পরে কেউ যদি আপনার নাম উচ্চারণ করে তবে তা করবে এজন্য যে, আপনি গগন পাল আর চন্দ্রভান গর্গের বন্ধু ছিলেন!
কথাটা জীবনে এই প্রথম শুনছেন না ডক্টর দ্বৈপায়ন লাহিড়ী। তফাত এই যে, প্রথমবার সেটা পাগলের প্রলাপ মনে হয়েছিল–এবার আর তা হল না!
.
১৭.
দীর্ঘ কাহিনীর উপসংহারে দাদু বললেন, গগনের বিরুদ্ধে আমার পর্বত-প্রমাণ অভিযোগ ছিল। তাকে আমি আজীবন ক্ষমা করিনি। শান্তি দেবীর প্রতি তার নিষ্ঠুরতা, বাবলু-মিণ্টির প্রতি তার নিমর্ম ঔদাসীন্য, বটুকের প্রতি নিক্ষিপ্ত তার পৈশাচিক বিদ্রূপ এবং সুলেখার প্রতি নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতায় আমি মর্মান্তিক ক্ষুব্ধ ছিলাম। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে আমার মনে যে হিমালয়ান্তিক অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তার কৈফিয়ৎ গগন দিয়ে গেছে একটিমাত্র ছত্রে :
—A mans work is the explanation of that man!
একটা মানুষের সৃষ্টিই তার অস্তিত্বের কৈফিয়ত!
আর চন্দ্রভান! ভিন্সেন্ট ভান গর্গ মরেনি, মরতে পারে না! সে বেঁচে আছে এই আমাদেরই আশেপাশেই, –সে নিশ্চয় ফিরে এসেছে এই পৃথিবীতে। শুধু আমরা তাকে ঠিকমত চিনতে পারছি না। তোমাকে কি বলব নরেন, এই বৃদ্ধ বয়সে গোলদীঘির ধারে, কফি-হাউসের কোণায়, মুক্তি-মেলার আসরে আজও তাকে খুঁজে বেড়াই আমি। নিদারুণ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত কোন আর্টিস্টকে যখন কলকাতার ফুটপাতে স্কেচ করতে দেখি আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি! মনে হয়?–ঐ তো ভিন্সেন্ট! সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সেই ময়লা পায়জামা আর ছেঁড়া পাঞ্জাবি! হাতে ভঁড়ের চা, মুখে সবুজ-সুতোর বিড়ি! মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত-ঘরের সন্তান, –কোথায় লেখাপড়া শিখে চাকরিবাকরি করবি, বিয়ে-থা করবি, র্যাশন আনবি, সংসার করবি–তা নয়, ওরা ছবি আঁকতে বসেছে। বাড়িতে নিত্য গঞ্জনা, বন্ধুমহলে পাগলা বলে পাত্তা পায় না, বিয়ের বাজারে ওরা কানাকড়ি! কণ্ঠা বারকরা ঘাড় কুঁজো থুবড়িগুলো পর্যন্ত ওদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না! ওরা যে পাগলামির আগুনে ওদের হাতের সব রেখা–সৌভাগ্য-রেখা, আয়ু-রেখা, যশঃ-রেখা–সব পুড়িয়ে ফেলেছে! ভাল কথা বললে শোনে না, গাল দিলে ভ্রূক্ষেপ করে না–বেহায়াগুলোর দু কান কাটা! আমি ওদের মধ্যে খুঁজে বেড়াই–ওর মধ্যে নতুনকরে-জন্ম-নেওয়া কোষ্টা আমার সেই হারানো বন্ধু ‘কানকাট্টা সেপাই’ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ?