–প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী, আমি ছবির কিছুই বুঝি না। ও ছবিরও কিছু বুঝতে পারলাম না। মেঝে থেকে সিলিঙ পর্যন্ত চারদিকের দেওয়ালে একতিল কোথাও ফাঁকা নেই, এটুকু দেখলাম শুধু। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। একটা অতিকায় আদিম জন্তু যেন তার আঁশওয়ালা লেজ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আমি সিসটিন চ্যাপেলে মিকেলাঞ্জেলোর লাস্ট-জাজমেন্টও দেখেছি কিন্তু সেখানে মনকে তৈরী করেই নিয়ে গিয়েছিলাম–আমি জানতাম মিকেলাঞ্জেলো মহান শিল্পী, আমি জানতাম, সিটিন চ্যাপেল বিশ্বের এক বিস্ময়! কিন্তু এ কী! তাহিতি দ্বীপের এক দূরপ্রান্তে পর্ণকুটীরে এ জিনিস যে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। আমার কেমন মনে হল জানেন? একবার ইংল্যাণ্ডে ডার্টমুরে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। নীর অন্ধকার রাত্রি। শুধু আকাশ ভরা তারা ছিল। আমি হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছিলাম। মনে হচ্ছিল–এ পথ অসীমে গিয়ে মিশেছে, এ রাত্রিও বোধহয় নিষ্প্রভাত! বিশ্ব চরাচরে আমি একা, নিতান্ত একা! হঠাৎ আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে হাত বুলিয়ে দেখি যাতে হোঁচট খেয়েছি সেটা একটা কবর। আমার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। তারার আলোয় হঠাৎ নজর হল, পথ ভুলে আমি একটা গোরস্থানে এসে পৌঁছেছি! আমার চারদিকে শুধু কবর, কবর আর কবর! সারি সারি ক্রুশচিহ্ন! তারা হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছিল! কারা যেন উইলো পাতার নিঃসরণের সঙ্গে তাল রেখে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমাক বলতে চাইছিল তাদের অতীত ইতিহাসের কথা যখন তারা রক্ত মাংসের জীব ছিল! অথচ কবরগুলো বোবা! ভয়ে আমি সেবার আর্তনাদ করে উঠেছিলাম!…এখানেও ঐ প্রাচীরচিত্রের উলঙ্গ নরনারীর দল যেন আমাকে কী কথা বলতে চায়, বলতে পারছে না-বলছে, অথচ আমি বুঝতে পারছি না; এখানেও তেমনি কে যেন আমার কাঁধের উপর উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলল! কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। আমি চিৎকার করতে গেলাম, কিন্তু স্বর ফুটল না আমার কণ্ঠে! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি য়ামায়া!
ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম অন্ধকূপ থেকে। হ্যাঁ, য়ামায়াই। বারান্দার খুঁটি ধরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে প্রেতাত্মার মত।
–য়ামায়া! য়ামায়া!
মেয়েটা মুখ তুলে তাকায়। মেয়ে নয়, তার কঙ্কাল! তার প্রেতাত্মা!
তোমার মরদ কোথায়?
একই ভঙ্গিতে তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে এবারেও সে দেখিয়ে দিল দূরের আমগাছটা। আগের বার যে সমাধিস্থূপটা দেখেছিলাম তারই অদূরে পড়ে আছে গগন পালের মৃতদেহ। গলিত কুষ্ঠের অন্তিম অবশেষ! দুর্গন্ধটা তারই। গাছের ডালে বসে আছে কটা শকুন। গাছের আড়ালে ওগুলো শেয়াল অথবা নেকড়ে!..
গগ্যা মারা গিয়েছিল দুদিন আগে। য়ামায়া তাকে টানতে টানতে ঐ গাছতলা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। একটা গর্ত খুঁড়বার চেষ্টাও সে করেছে দুদিন ধরে। কিন্তু অনাহারে সে দুর্বল। একা হাতে অতবড় দানবটাকে সে মাটির বুকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। ঐ শকুন আর শেয়ালের হাত থেকে তার মরদকে রক্ষা করতেই বেচারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ডাক্তার ওয়াটকিন্স ওর হাত থেকে কোদালটা তুলে নিলেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সমাধিস্থ করলেন জঙলি মানুষটাকে। খাদ্যদ্রব্য কিছু ছিল না। ভাগ্যে উনি কিছু বিস্কুট আর পাঁউরুটি এনেছিলেন। কতদিনের অনাহার কে জানে? য়ামায়া দুর্ভিক্ষপীড়িতের মত খেল। ডাবের জল খেল। একটু সুস্থ হয়ে বসল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।
-ওর বাড়ির ঠিকানা জান?
য়ামায়া তার রুক্ষ চুলের মাথাটা ঝাঁকালো।
-তোমার ছোট ছেলেটাকে দেখছি না! সে কই?
এবারও একইভাবে মাথা ঝাঁকায়, অর্থাৎ সেটাও গেছে!
ডাক্তার সাহেব বলেন, ভেবে আর কি হবে য়ামায়া! তুমি আমার সঙ্গে চল, তোমাকে গ্রামে পৌঁছে দিয়ে যাব।
আবার মাথাটা ঝাঁকায় বলে, -ঐ ঘরটা–
-ঘরটা?
তাই তো। ঘরখানার কথা মনে পড়ল এতক্ষণে। ওটার কথা মনেই ছিল না। ঘরটায় কি যেন অদ্ভুত সব ছবি আঁকা আছে না? কি ছবি? মনে পড়ছে না। অথচ ঘন্টাখানেক আগে ওটার ভিতর অদ্ভুতদর্শন কি যেন দেখেছিলেন মনে পড়ছে। ভয় পেয়েছিলেন। এবার য়ামায়াকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করেন সেই পাতায় ছাওয়া ঘরখানায়। দেওয়ালের ছবিগুলো ভাল করে দেখতে।
অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী আর কৌতূহল দমন করতে পারেন না। বলেন, চিত্রের বিষয়বস্তুটা ঠিক কি ছিল বলুন তো? কী বলতে চেয়েছেন শিল্পী।
তা আমি কি জানি? কিছুই বোধগম্য হয়নি আমার। একটা আদিম অরণ্যকে দেখেছিলাম, এটুকু মাত্র মনে আছে। সৃষ্টির আদিতে আদম আর ঈভ যে অরণ্যে বাস করত সেই হারিয়ে যাওয়া বনভূমিই যেন এতদিনে প্রাণ পেয়ে উঠেছে। অদ্ভুত সুন্দর সে বনভূমি বীভৎস আর ভয়াবহ। প্রকৃতির অন্তর্লীন আত্মাকেই উদঘাটিত করেছেন শিল্পী। গাছপালা, পাহাড় আর নদী–সবই যেন জীবন্ত। সবই যেন প্রাণরসে ভরপুর প্রতিটি পার্চিং স্টোন! আর সেই আদিম অরণ্যে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে কতকগুলো অপার্থিব অদ্ভুত জীব। তারা বিশ কোটি বছর আগেকার জুরাসিক যুগের অতিকায় টিরানোসরাসের স্বগোত্র হতে পারে, আবার অতি আধুনিক মানব-মনের অবচেতন-অরণ্যের বাসনা কামনাও হতে পারে! আর ছিল মানুষ–হ্যাঁ, পুরুষ-স্ত্রী-শিশু বৃদ্ধ-পূৰ্ণযৌবনা নারী! সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের কেউ কেউ আবার টেরোডেটিলের মত আকাশে ভেসে। চলেছে। তাদের সত্তা আছে, ওজন নেই। ওরা মানুষের মত দেখতে, অথচ ঠিক মানুষ। নয়। যেন অস্থি-মজ্জা-মেদ-রক্ত-মাংস দিয়ে ওদের গড়েননি সৃষ্টিকর্তা–গড়েছেন ঈর্ষা প্রেম-দ্বন্দ্ব-করুণা আর জিঘাংসা দিয়ে। তারা মানুষখেকো বাঘের মত নিষ্ঠুর অথচ দেহাতীত প্রেমের মত স্বর্গীয়! আমি আপনাকে বোধ হয় ঠিক বোঝাতে পারছি না প্রফেসর। তবে এটুকু বলব, আপনি নিজেও সে ছবি দেখলে চমকে উঠতেন। কারণ আপনার মনে হত ওগুলো কোন অলৌকিক জীবের চিত্র নয়। মনে হত ওগুলো আদৌ কোন ছবি নয়–দেওয়াল-জোড়া ওটা একটা আয়না; কারণ আপনার প্রতিবিম্বই দেখতে পাচ্ছেন আপনি! ও ছবি আপনারই!