কাত হয়ে পড়েছে ঘরটা। সংস্কারের অভাবে। য়ামায়া কুটিরের সামনে একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নারকেলের ছোবড়া ছাড়াচ্ছিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ সে। পদশব্দে ব্ৰস্তা হরিণীর মত ঘরের ভিতর ছুটে পালিয়ে যায়। ডাক্তার-সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। একটু পরে ফিরে আসে য়ামায়া, তার মাজায় জড়ানো একখণ্ড কাপড়। কাকালে সেই শিশুটি। বছর দুই বড় হয়েছে ইতিমধ্যে।
-তোমার মরদকে দেখতে এসেছি. সে কোথায়?
–আচ্ছা, ওকে খবর দিই।
য়ামায়া ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। ডাক্তার সাহেবও ওর পিছন পিছন যাচ্ছিলেন, হাত নেড়ে বারণ করল মেয়েটি। দ্বারের বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়েন উনি। খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছে একটা দুর্গন্ধ। এ গন্ধ ডাক্তার সাহেবের পরিচিত। গলিত কুষ্ঠের পুঁজের গন্ধ। ঘরের ভিতরে যে কথোপকথন হল তা সবই স্বকর্ণে শুনলেন উনি। গগনের কণ্ঠস্বর বিকৃত। ডাক্তার সাহেব বুঝতে পারেন ওর গলার স্বরনালীও এতদিনে মহামারীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত। য়ামায়া বেরিয়ে আসে। বলে, –ও দেখা করবে না। তুই চলে যা।
একথা স্বকর্ণেই শুনেছিলেন ডাক্তার সাহেব। তবু তিনি পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু প্রভুভক্ত কুকুরীর মতই য়ামায়া দরজা আড়াল করে দাঁড়াল। ভিতরে যেতে দিল না ওঁকে। ডাক্তার সাহেব হতাশায় কাঁধ ঝাঁকালেন। উপহারের পুটলিটা দাওয়ায় রেখে পিছন ফিরলেন। অহেতুক এতটা পথ হেঁটে এসেছেন তিনি। তারপর য়ামায়াকে বলেন, তোমার মেয়েকে ডাক, আমাকে ফিরে যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিক।
-সে নেই।
নির্বিকার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দূরের আমগাছ তলাটা দেখিয়ে দিল। সদ্য কবর দেওয়া হয়েছে কাউকে, মাটিটা উঁচু হয়ে আছে। সহানুভূতিতে ডাক্তার সাহেবের মনটা ভারী হয়ে আসে। বলেন, এখানে তুমি কেন পড়ে আছ? তুমি পাপীতিতে ফিরে যাও। ও বাঁচবে না। ওকে মরতে দাও।
আয়ত দুটি চোখ মেলে য়ামায়া একবার তাকায়। সে রীতিমত রোগা হয়ে গেছে। চোখ দুটি বসে গেছে। চোয়ালের হনু দুটো উঁচু হয়ে উঠেছে। আজকাল সেও বোধকরি চুল আঁচড়ায় না, মাথায় জটা হয়ে গেছে তার। বললে, –ও যে আমার মরদ!
এত দুঃখেও হাসি পেল ডাক্তার সাহেবের। ঠিকই, বলেছিল সেদিন ঐ জঙলি মানুষটা! মেয়েমানুষ জাতটাই নিমকহারাম! যুগ-যুগান্তর ধরে তালিম দিয়েও সভ্য সমাজ ওদের শেখাতে পারেনি মানব-জীবনের সেই মূল মন্ত্রটা–চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!
–আবার যদি কখনও এদিকে আসি, তোমাদের জন্য কি নিয়ে আসব?
–কিছু রঙ। ।
রঙ? ও কি এখনও ছবি আঁকতে পারে?
–ও তো ছবিই আঁকছে বসে। দিন-রাত ছবি আঁকে।
–ও ক্যানভাস পায় কোথায়?
না, দেওয়ালে ছবি আঁকছে এখন।
–কী রঙ চাই, ওকে জিজ্ঞাসা করে এস।
য়ামায়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, –যে কোন রঙ। ও তো চোখে দেখে না। দুটি চোখই ওর নষ্ট হয়ে গেছে।
এ আবার কী কথা? যে চোখে দেখতে পায় না সে ছবি আঁকে? ডাক্তার সাহেব আর কথা বাড়াননি। য়ামায়া ওঁকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেল। লোকালয়ের কাছাকাছি এসে বললে, –এবার আমি যাই। ওরা দেখতে পেলে ইট মারবে!
আরও মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন বিলাতের ডাক এসেছে। ডাকে এক বাক্স স্যাম্পেল ওষুধ পেলেন ডাক্তার সাহেব। সদ্য আবিষ্কার। কুষ্ঠ রোগের। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল টারাভাওয়ের সেই অন্তেবাসী শিল্পীর কথা। য়ামায়া কিছু রঙ চেয়েছিল, তাও তো দিয়ে আসা হয়নি। এবার কেউ তাকে ডাকেনি। তবু অন্তরে য়ামায়ার আহ্বান শুনতে পেলেন যেন। ওষুধের প্যাকেট, কিছু খাবার আর কয়েক টিউব রঙ নিয়ে উনি স্বতঃপ্রবত্ত হয়ে আবার এলেন টারাভাওয়ে।
টারাভাওয়ের লোকেরা বললে, য়ামায়া এখনও ফিরে আসেনি। এবারও একাই তাকে সেই পাকদণ্ডীর পথ বেয়ে পাহাড়ে উঠতে হল। এবার আদিম অরণ্য আরও নির্ভয়ে অগ্রসর হয়ে এসেছে পথ-চলতি পাকদণ্ডী সড়কের উপর। সেটার চিহ্নমাত্র নেই। তবু দুবার এ পথে এসেছেন। অনেকটা চেনা হয়ে গেছে। অবশেষে পাহাড়ের মাথায় সেই পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরখানির সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবার য়ামায়ার সাড়া পাওয়া গেল না। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু অজানা পাখির ডাক, আর বন-ঝিঁঝির একটানা একটা শব্দ। ডাক্তার ওয়াটকিন্স পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে যান ঘরের দিকে। হাট করে ভোলা আছে দরজাটা। ঘরটা আরও বেঁকে গেছে। বারান্দায় ভাঙা একটা মাটির কলসী। জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। য়ামায়ার নাম ধরে ডাকলেন বার দুয়েক। প্রতিধ্বনিই ফিরে এল শুধু। খোলা দরজা দিয়ে একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। নাকে রুমালটা চেপে ধরেন তিনি। তারপর ভিতরে ঢুকে পড়েন।
ভিতরটা রীতিমত অন্ধকার। দরজাটা অত্যন্ত ছোট–তা দিয়ে অল্প আলো আসছে, জানলাটা বন্ধ। প্রখর সূর্যালোক থেকে ও-ঘরে ঢুকে কিছুই দেখতে পেলেন না উনি। তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেল। সান্ধ্য-আকাশের তারার মত এখানে ওখানে একটি একটি করে ফুটে উঠল কয়েকটি দৃশ্য। কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল ওঁর। এ কী! উনি তো কোন ঘরের ভিতর নেই–তার চারদিক ঘিরে শুধু গভীর অরণ্য! গাছ গাছ আর গাছ! পাহাড় ঝরনা-ঘন বেতের ট্রপিক্যাল জঙ্গল! দূরে দূরে কিছু নারকেল গাছ, আম গাছ–আর বাদবাকি সবই অচেনা গাছ। কিন্তু জঙ্গল তো নির্জন নয়। ঐ তো কতকগুলি সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানুষ!