তাহিতি দ্বীপে কুষ্ঠরোগোক্রান্তদের পৃথকীকরণের কোন ব্যবস্থা নেই।
হঠাৎ অশ্রুআর্দ্র মুখ তুলে য়ামায়া বলে ওঠে, ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে না?
গগন বলে, -না। তার আগেই আমি জঙ্গলে চলে যাব।
ডাক্তার সাহেব বলেন, জঙ্গলে মানে? এটাই তো জঙ্গল।
-না। আরও গভীর জঙ্গল আছে পাহাড়ের ওপাশে। সেখানে আদিবাসীরাও যায় । সেখানে এই ন্যাকড়াখানাও মাজায় জড়াবার দরকার হবে না। মিশে যাব অরণ্যে।
ডাক্তার সাহেব মনের চোখ দিয়ে দেখতে পান দৃশ্যটা। সভ্য জগতের একটা মানুষ আদিম অরণ্যে সম্পূর্ণ অরণ্যচারী হয়ে গেছে! বেবুন- সিম্পাঞ্জি-গেরিলার স্বগোত্র সে। একমাথা চুল, একবুক দাড়ি নিয়ে এই বিংশ শতাব্দীতে তাহিতি দ্বীপের কোন অনাবিষ্কৃত। পর্বতকরে আবার একটা উলঙ্গ নিও-হোমোস্যাপিয়ান নূতন আলতামেরার সৃষ্টি করছে!
য়ামায়া উঠে আসে। ককালে নিয়েছে উলঙ্গ বাচ্চাটাকে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। শুধু। মাতৃত্বের অমৃতরসে নয়, উত্তেজনাতেই যেন ফুলে উঠেছে তার বুক। কটিদেশে একমাত্র লাজবস্ত্র। দুচোখে আর তার জল নেই, আছে আগুন। বললে, না! তোকে আমি একলা যেতে দেব না! আমরা সবাই যাব!
কী পাগলি রে তুই!–ওকে ধমক দেয় গগ্যা। বলে, –তোর তো আর অসুখ করেনি। তুই পাপীতিতে ফিরে যা। তোর আবার বিয়ে হবে, নতুন মরদ পাবি, সংসার পাবি। ছেলেমেয়েরা রইল। তুই কেন মরতে যাবি আমার সঙ্গে? কী এমন বয়স তোর?
হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল য়ামায়া। বাঁ কাঁকালে শিশু–ডান হাত দিয়ে সে জড়িয়ে ধরল প্রকাণ্ড দৈত্যটার হাঁটু; আর্ত চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল বনভূমি—
-না, না, না! তুই আমার মরদ! তোকে ছেড়ে আমি বাঁচব না!
পাথরে গড়া পল গগ্যার অক্ষিকোটরেও তাহলে জল থাকে! অর্ধশতাব্দীকাল দুনিয়াদারি করে গগন পাল নিজেই কি সেটা জানতে পেরেছিল কোনদিন? ফোলা ফোলা কুষ্ঠগ্রস্ত লাল গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ল য়ামায়ার রুক্ষ চুলে। দু চোখে জল, তবু অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল পাগল শিল্পী। সভ্যজগতের একমাত্র সাক্ষীটাকে দেখে ইংরাজীতে বললে, -মেয়েমানুষ জাতটাই এমনি নেমকহারাম! সমাজ আজও ওদের শেখাতে পারেনি সভ্যতার মূল মন্ত্রটা–চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! স্রেফ জোঁকের মত! যাকে ধরে তাকে ছাড়ে না! জোঁকের তবু নুন আছে; এরা নিমককেও ভয় পায় না, এমনই নেমকহারাম!
য়ামায়া বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারে না? সচকিত হয়ে মুখ তুলে বলে, -কী কী বলছিস তুই ডাক্তার সাবকে? আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
না রে পাগলি! তাই কি পারি! আমি যে তোর মরদ!
ডাক্তার ওয়াটকিন্স প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এ-রোগে রোগীকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াটা প্রহসনের মত শোনাবে। তাই নীরবেই বিদায় নিলেন। পাকদণ্ডী পথে ফিরে চললেন ছবিটা নিয়ে। পাপীতিতে ফিরে এলেন পরদিন সন্ধ্যায়। ক্রমে ভুলে গেলেন দ্বীপান্তরের একটি জঙলি কুষ্ঠরোগীর কথা।
প্রায় দু বছর পরে আবার তার কথা মনে পড়ল তার। কারণ বছর দুয়েক পরে আবার তিনি রুগী দেখতে এসেছিলেন টারাভাওতে–সেই মোড়লনীকে দেখতে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কুষ্ঠরোগীটার কথা। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, পাহাড়ের মাথায় সেই দাড়িওয়ালা জঙলি বিদেশীটা বেঁচে আছে?
–আছে বোধহয়।
বোধহয়। ওরা ঠিক জানে না। এ শুধু অনুমান। বছরখানেক আগেও তাকে দেখা গেছে। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড একটা মানুষ নির্জন পাহাড়-পর্বতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাথা রুক্ষ চুল, একবুক কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখখানা কেশর-ফোলানো সিংহের মত থমথমে। খালি গা, খালি পা। ছবি আঁকত সে পাহাড়ের ধারে, -ঝরনার কিনারে কখনও দূর সমুদ্রের বেলাভূমিতে। কখনও মধ্য রাত্রে ভেসে আসত একটা বাঁশের বাঁশীর সুর। গ্রামের দিকে ভুলেও আসত না। আসত য়ামায়া, গভীর রাত্রে চুপিচুপি। গ্রামের এক দোকানদারের কাছ থেকে সওদা করে নিয়ে যেত। বিনিময় প্রথা। নিয়ে আসত মুরগী, ডিম, নারকেল, কলার কাঁদি। নিয়ে যেত নুন, মোমবাতী, দেশলাই, কাপড়। দিনের বেলা আসত না। গ্রামের মানুষ সহ্য করত না তাকে। ও যে ছোঁয়াচে রুগীর রোগজীবাণু সর্বাঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর ছেলেমেয়েরাও আসে না গ্রামে। তারপর আর বছরখানেক লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবু সে মরেনি বোধহয়। কারণ তাহলে য়ামায়া ফিরে আসত। য়ামায়া যে বেঁচে আছে এটুকু ওরা জানে, তাকে চোখে না দেখলেও। বাঁশীর শব্দটাও বন্ধ হয়েছে।
এবার কেউ ওঁকে যেতে বলেনি। তবু ডাক্তার ওয়াটকিন্স একটা মলম, কিছু বিস্কুট, গুঁড়ো দুধ, দেশলাই আর নুন নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলে স্থির করলেন। কেউ পথ দেখিয়ে সঙ্গে যেতে রাজী হল না। ও পাহাড়টা নিষিদ্ধ-অঞ্চল বলে মেনে নিয়েছে ওরা। অগত্যা একাই রওনা হলেন তিনি।
বনপথটা মুছে এসেছে। পায়ে-চলা পথে পায়ের দাগ আজকাল পড়ে না। দু পাশের আদিম অরণ্য তার সাবেক অধিকার ফিরে পাওয়ার উৎসাহে ঝুঁকে পড়েছে। পথে অসংখ্য ডাব পড়ে আছে; কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যায়নি। গতবার এত বন্য জন্তুও দেখেননি। এবার খরগোশ আর বন্য মোরগদের দেখলেন নির্ভয়ে পথের উপর চলাফেরা করতে। পায়ে-চলা পথটা ক্রমশঃ মিলিয়ে এসেছে–বু ক্ষীণ একটা চিহ্ন আজও আছে। তাই শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারলেন পাহাড়ের মাথায় সেই পাতায় ছাওয়া কুটিরের সামনে।