আয়নায় কিছু দেখতে পাচ্ছেন?
জঙলি মানুষটা আজ দশ বছর চুল আঁচড়ায়নি, দাড়ি কামায়নি। কত যুগ-যুগান্তর পরে সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল তা তার মনেই পড়ে না। সত্যি কথা বলতে গেলে তাকে স্বীকার করতে হত্যা, আমার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে।
–তা সে বলল না কিন্তু। বললে, কী আবার দেখব? নিজের মুখটাই দেখছি।
কিছু নজরে পড়ছে না? একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন না? নাকটা ফোলা ফোলা, গাল দুটো লাল লাল–মুখখানা কেশর ফোলানো সিংহের মত মনে হচ্ছে না কি?
গগন জবাব দেয় না। একদৃষ্টে নিজ প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু যেন দিশেহারা।
মিস্টার পাল, আমি দুঃখিত–আপনার একটা দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে!
দুরারোগ্য ব্যাধি?…আমার?…কি হয়েছে আমার?
দুটি মাত্র অক্ষর। কিন্তু কথাটা আটকে গেল অভিজ্ঞ ডাক্তার সাহেবের মুখে।
ডক্টর ওয়াটকিন্স অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীকে বলেন, –প্রফেসর, ত্রিশ বছর প্র্যাকটিস করছি আমি। দুরারোগ্য ব্যাধি যেখানে ধরা পড়েছে আমার সন্ধানী দৃষ্টিতে সেখানে আমি অকপটে সেকথা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করিনি কখনও। এই আমার নিয়তি। লোকে বলে, আমি কর্কশভাষী। কি করব বলুন? কিন্তু এ জাতীয় মর্মান্তিক দুসংবাদ আমি সচরাচর রোগীকে বলি না; বলি তার নিকট আত্মীয়কে। যেখানে নিকট আত্মীয় কেউ নেই, সেখানে বাধ্য হয়েই কথাটা রোগীকে বলতে হয়েছে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তার অনিবার্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছি যাতে হতভাগ্য মানুষটা সেটা সহ্য করার কিছু সময় পায়। কিন্তু এবার আমি ছিলাম নিতান্ত নিরুপায়।
জঙলি মানুষটা আয়নাখানা মাটিতে নামিয়ে রাখে। এগিয়ে আসে সামনে। দু হাত মাজায় রেখে ডাক্তার সাহেবের মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে, বলুন! কী হয়েছে আমার?
এবার চুপ করে থাকা চলে না। দুটি মাত্র অক্ষরে মৃত্যুদণ্ডজ্ঞা ঘোষণা করলেন ডাক্তার ওয়াটকিন্সঃ
কুষ্ঠ!
আশ্চর্য লোকটার মনের জোর! এত বড় বজ্রাঘাত সে গ্রহণ করল অবিচলিত চিত্তে। কেঁপে উঠল না থরথর করে, বসে পড়ল না মেঝেতে; মুখের একটি পেশীও কুঞ্চিত হল না। মিনিটখানেক নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে বললে, মায়া জানে?
এ রোগ এ দ্বীপে এত ব্যাপক যে, ওর বুঝতে অসুবিধা হয়নি বোধহয়। না হলে আপনার সামান্য জ্বর দেখে সে এভাবে আমাকে ডেকে আনত না।
গগন পাল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। দেখে, দাওয়ায় ও-প্রান্তে বসে আছে। য়ামায়া। দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর নগ্ন বুকে বাচ্চাটা লেটে আছে। বড় মেয়েটা দূরের আমগাছের আড়ালে আত্মগোপন করেছে-তার চোখে আতঙ্ক। গগন হাত বাড়িয়ে বাঁশের খুঁটিটা ধরে। ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে মুখ তুলে অস্ফুটে কি যেন স্বগতোক্তি করে। দুর্বোধ্য ভাষায়। তার মাতৃভাষায়। ডাক্তার ওয়াটকিন্স জানেন না–সে কী বলেছিল, কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল। অনুমান করতে পারেন না–সেটা খেদোক্তি, অভিশাপ, না প্রার্থনা।
..কী বলেছিল গগন? কাকে বলেছিল? তাহিতির রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের দিকে মুখ তুলে কার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার? পুরনো পল্টনের মেয়েদের স্কুলের কোন দিদিমিণি? তার আঁকড়াচুলো ফ্রক-পরা মেয়েটা, না কচি শালের চারার মত তার দাদাকে? অথবা হয়তো মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মনে পড়ে গিয়েছিল আর একটি শ্যামাঙ্গী মেয়েকে সুলেখা দেবনাথকে। ও কি দুনিয়াকে ডেকে বলেছিল–তোমরা দেখে যাও, তোমাদের সব অভিশাপ আমি মাথা পেতে নিয়েছি! ঈশ্বরকে অভিশাপ। দিয়েছিল কি? অথবা হয়তো জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে সে তার অনবদ্য উদাসীনতায় ঝট দিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিল ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর ঐ ছেঁদো মৃত্যুদণ্ডাদেশ; বলেছিল, ঝাঁট দে!
ঘুরে দাঁড়ায়। দেখে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছেন ডাক্তার সাহেব।
–ডক্টর! কতদিনের মেয়াদ আমার?
-তা কে বলতে পারে? কখনও কখনও দীর্ঘ বিশ বছরও এ রোগের মানুষকে ভুগতে দেখেছি। দু-এক বছরের মধ্যে যার যন্ত্রণার অবসান হয় সেই তো ভাগ্যবান। মৃত্যুই এরোগে একমাত্র আশীর্বাদ!
গগন পাল ধীরে ধীরে ফিরে যায় তার কুটিরে। বেরিয়ে আসে পরক্ষণেই। হাতে তার সদ্য সমাপ্ত একটি অয়েলকালার। সেটা বাড়িয়ে ধরে আগন্তুকের দিকে বলে, — ডক্টর, ভিজিট দেবার ক্ষমতা য়ামায়ার নেই। তুমি এই ছবিটা নিয়ে যাও বরং।
ডাক্তার সাহেব বলেন, ধন্যবাদ। ভিজিট তোমাকে দিতে হবে না।
হঠাৎ চটে গেল জঙলি লোকটা। গম্ভীর স্বরে বললে, –ডক্টর! আমার স্ত্রী গরীব। কিন্তু গরীবের আত্মসম্মানজ্ঞান থাকবে না, এমন কোন কথা নেই। এটা ধর। আর তুমি যা ভাবছ তা ঠিক নয়। এখানা যত্ন করে রেখে দিও। একদিন এ ছবি তোমার ভিজিটের শতগুণ তোমাকে ফেরত দেবে। কথাটা আজ তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, নয়?
বিশ্বাস সত্যিই হয়নি ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর। তাহিতির একটি নিসর্গচিত্র। পাহাড় আর গাছ, পিছন-ফেরা বাঁক কাঁধে একটি মাত্র মেহনতি মানুষ। ছবির ফ্রেমটাও নিতান্ত বাজে কাঠের। বিশ্বাস হবার কথাও নয়। তবু একটি মৃত্যুপথযাত্রী চিত্রকরের শেষ অভিমানটাকে আঘাত করতে মন সরেনি। হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছিলেন ছবিটা। ও পাশে য়ামায়া তখন ফুলে ফুলে কাঁদছে। গগন তাকে ধমকের সুরে সান্ত্বনা দেয়, আরে বুদ্বুর মত কাঁদছিস কেন রে পাগলি?