–ও কার মেয়ে? কি চায়? জানতে চাইলেন উনি।
ভীড়ের মধ্যে কে যেন বলে, –ও হচ্ছে দাড়িওয়ালা পাহাড়িয়ার মেয়ে। ভিখারী নয়।
দাড়িওয়ালা পাহাড়িয়া? সে আবার কে? ওরা বুঝিয়ে বলে, –উই পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের ভিতর বাস করে একজন দাড়িওয়ালা বিদেশী। আর থাকে তার বউ। মেয়েটি ওদেরই। ডাক্তার সাহেব গ্রামে এসেছেন শুনে ও তাঁকে ডাকতে এসেছে। ওর বাপ, ঐ বিদেশীটার কি অসুখ করেছে বলছে। কিন্তু মুশকিল এই যে, ওদের ঐ কুঁড়েঘরে যেতে হলে পাকদণ্ডী পথ দিয়ে হাঁটাপথে যেতে হবে। গাড়ি যাবে না। তাও পাক্কা তিন মাইল। ডাক্তার সাহেব জানতে চান বিদেশীর পরিচয়, কোন্ দেশের লোক, কি নাম। ওরা বললে, তা ওরা জানে না। লোকটা কোন কাজকাম করে না। স্রেফ ছবি এঁকে দিন কাটায়। আর বাঁশী বাজায়। তবে খায় কি?কি আবার খাবে? জঙ্গলের ফলমূল, নারকেল; আর ওর বৌ য়ামায়া একপাল মুরগী পুষেছে। শহরে এসে ডিম, মুরগী বেচে যা পায় তাই খায়। গাঁয়ের লোকেরা ঐ বিদেশীর উপর চটা। লোকটা জেলখাটা দাগী আসামী। সেটা বড় অপরাধ নয়–পুলিসের হাতে পড়লে জেল তো খাটতেই হবে, সে কথা নয়, কিন্তু লোকটা অমন ছন্নছাড়া কেন? না ধরে মাছ, না করে চাষবাস, না পারে নারকেল গাছে উঠতে, না যায় সাহেবের খামারে খাটতে।
ছোট মেয়েটা তখনও পিছন ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ডাক্তার সাহেবের শুধু কৌতূহলই নয়, করুণাও হল। একটা বিদেশী অসুস্থ মানুষকে না-দেখে ফিরে যেতে তার মন সরল না। বলেন, চল্ রে, আমি যাব তোর বাপকে দেখতে।
মেয়েটি তুরুক করে এদিকে ফেরে। খুশিতে ওর জলভরা দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে।
পাক্কা তিন মাইল চড়াই ঠেঙিয়ে ডাক্তার সাহেবের মেজাজ খিঁচড়ে গেল। দেহও ক্লান্ত। পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি পাতায়-ছাওয়া কুটির। পথের উপরেই বিদেশীর স্ত্রী–ঐ য়ামায়া দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা মুখকাটা ডাব। মেয়েটিকে বুদ্ধিমতী বলতে হবে। এতটা পথ চড়াই ভেঙে এসে ডাক্তার সাহেব যে প্রথমেই জল চাইবেন তা ঠিকই আন্দাজ করেছে সে।
ডাবটা নিঃশেষ করে ডক্টর ওয়াটকিন্স বলেন, কোথায় তোর মরদ?
মেয়েটি তার ডান হাতটা বাড়িয়ে পাতায়-ছাওয়া কুটিরখানি দেখিয়ে দিল। দরজাটা খোলাই আছে। দাওয়ার উপর বস্ত্র দেড়েকের একটা উলঙ্গ শিশু খেলা করছে।
কি হয়েছে রে তোর মরদের? কি করছে সে? ঘুমোচ্ছে?
না, ও ছবি আঁকছে।
–ছবি আঁকছে! বলিস কি রে? তাহলে পাহাড়ের মাথায় আমাকে হটিয়ে আনলি কেন? সে গাঁয়ে যেতে পারত না?
য়ামায়া একথার জবাব দিল না। মুখ নিচু করে নখ খুঁটতে থাকে। বাচ্চাটাকে তুলে নিল কোলে। তারপর এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। ঘরে ঢোকে না কিন্তু। দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল ওঁকে ভিতরে যেতে। ওর ব্যবহারে একটু অবাক হলেন ডাক্তার সাহেব। এগিয়ে এলেন তিনি ঘরের ভিতর। সেখানে একজন বিদেশী লোক মাটিতে বসে একখানা ছবি আঁকছে আপন মনে। রঙ-তুলি চারদিকে ছড়ানো। লোকটা কোন্ দেশের তা বোঝা যায় না। একমাথা রুক্ষ চুল, একমুখ দাড়ি-ঊধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পদশব্দে সে পিছনে ফিরে তাকায়। ডাক্তার সাহেবকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে বিস্ময়ের চেয়ে বিরক্তিই বেশি। ওর ভ্রতে জেগেছে একটা কুঞ্চন। হঠাৎ রুখে ওঠে জঙলি লোকটা। বলে, কি চাই?
ডাক্তার সাহেব এক কথায় জবাব দিতে পারলেন না। বলতে পারলেন না আমি কিছু চাই না, তোমার স্ত্রী আমাকে ডেকে এনেছে। অভিজ্ঞ ডাক্তার ওর মুখে শুধু বিরক্তির ব্যঞ্জনাই দেখেননি–দেখতে পেয়েছিলেন গভীরতর আর কিছু। গ্রহণের আগে সূর্যের উপর যেমন একটা ধূসর বর্ণের পেনাস্ত্রীয় স্নান ছায়াপাত হয়, তেমনি ঐ দৈত্যের মত মানুষটার মুখে কোন্ অলক্ষ্য মহাকাল এক করাল ছায়াপাত করেছেন। ওঁর পা দুটি যেন মাটিতে প্রোথিত হয়ে গেল। মানুষটার অভদ্র ব্যবহারে রাগ করতে ভুলে গেলেন। তিনি। নিরতিশয় বেদনা আর করুণায় তার অন্তঃকরণ আপ্লুত হয়ে গেল। বললেন, আপনার নাম কি? আপনি কোন্ দেশের লোক?
–সে খোঁজে আপনার কি প্রয়োজন? বডি-ওয়ারেন্ট আছে?
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি ভুল বুঝছেন!
কিছু ভুল বুঝিনি। আমি তো দুনিয়াকে ছেড়ে এসেছি। তবু
-আপনি অহেতুক রাগ করছেন। আমি পুলিসের লোক নই। আমার নাম ডক্টর ইভান ওয়াটকিন্স। আমি পাপীতিতে প্র্যাকটিস করি। টারাভাওয়ে রুগী দেখতে এসেছিলাম। আপনার স্ত্রী য়ামায়া আমাকে ডেকে এনেছে। আপনি নাকি অসুস্থ।
য়ামায়া একটা গাড়োল। আমার কিছু হয়নি। একটু জ্বর মত হয়েছিল, আর গা হাত পায়ে ব্যথা আছে। ও কিছু নয়, দুদিনেই সেরে যাবে। ভাল কথা, আপনার ব্যাগে কুইনিন আছে?
-আপনি আমার আগের প্রশ্নের জবাব দিন। আপনার পরিচয়?
আমার নাম গগন পাল। আমি ভারতীয়। কুইনিন আছে আপনার ব্যাগে?
–আছে। কিন্তু আপনার ম্যালেরিয়া হয়নি। কুইনিন খেতে হবে না আপনাকে।
—ও!
আপনি ঐ আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখুন দেখি—
–কেন?
ডাক্তার সাহেব জবাব দেন না। লোকটা একটু অবাক হয়ে যায়। তার দৃষ্টি চলে যায় ঘরের ওপ্রান্তে। সেখানে পড়ে ছিল কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা সস্তা হাত-আয়না আর কাকুই। য়ামায়ার প্রসাধনের সরঞ্জাম হয়তো। বারকতক পর্যায়ক্রমে ডাক্তার সাহেব এবং ঐ আয়নাটার দিকে তাকিয়ে লোকটা সেদিকে এগিয়ে যায়। তুলে নেয় হাত-আয়নাটা। সরে আসে জানালার কাছে, আলোর দিকে। নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে থাকে নিজ প্রতিবিম্বের দিকে।