অধ্যাপক অতঃপর কামিল দমিয়ে, অ্যাডভোকেটের সঙ্গে দেখা করলেন।
কামিল দমিয়ে জাতে ফরাসী। উদারনৈতিক তরুণ উকিল। বললেন, হ্যাঁ, পল গগ্যাকে আমি চিনতাম। সাত-আট বছর আগে। সত্যি কথা, তিনি ফরাসী জানেন না। তিনি কোন্ দেশের লোক তা জানা নেই। Le Sourireতে প্রকাশিত প্রবন্ধটা গগ্যারই লেখা, তবে তিনি ইংরাজিতে লিখেছিলেন। অন্য কেউ সেটা অনুবাদ করে দেন। কে যে। অনুবাদ করেন তা গগ্যা স্বীকার করেননি। গগ্যা ছিলেন ডাকাবুকো ধরনের দুঃসাহসী লোক। আদালতে তিনি বলেছিলেন তিনি ফরাসী ভাষা জানেন না–সেকথা বিচারক বিশ্বাসও করেছিলেন। কিন্তু গগ্যা বলেন প্রবন্ধের বক্তব্য তারই, তিনি ইংরাজিতে ওটা লিখেছিলেন। কে অনুবাদ করেছেন এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে অস্বীকার করেন।
–অদ্ভুত লোক তো! বলেন ম্যাকগ্রেগরী।
দমিয়ে বলেন, অতি অদ্ভুত লোক। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি যে বিনা পারিশ্রমিকে তার কেস হাতে নিতে চেয়েছিলাম এজন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমি জিজ্ঞাসা করি–আপনি কি এ দ্বীপের দেশীয় আন্দোলনে যোগ দিতে চান? জবাবে গগ্যা বলেছিলেন না। আমি এই তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে গভীরতর অরণ্যে চলে যাচ্ছি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেখানে। কী করবেন আপনি? জবাবে উনি বলেছিলেন–ছবি আঁকব। বুঝলেন প্রফেসর, জিনিসটা আমার কাছে একেবারে উদ্ভট লেগেছিল–শিক্ষিত সভ্য একজন মানুষ এভাবে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একটা পলিনেশিয়ান মেয়েকে নিয়ে অমন জঙ্গলে গিয়ে কেমন করে বাস করতে পারে আমি তো ভেবে পাইনি। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম–How could you explain yourself? আপনি এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কি ব্যাখ্যা দেবেন? লোকটা জবাবে কি বললেন জানেন?
-কি?
বললে, A mans work is the explanation of that man–একটা মানুষের সৃষ্টিই তার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা!
প্রফেসর মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এর চেয়ে খাঁটি কথা হয় না!
মোটকথা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি ম্যাকগ্রেগরী–তবু শিল্পীর কোন সন্ধান পেলেন না। শিল্পীর সৃষ্টির মাধ্যমেও যে কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাবেন তারও সুযোগ হল না। গগন পালের হাতের কোন কাজ দেখতে পেলেন না কোথাও। বাধ্য হয়ে ব্যর্থমনোরথ ম্যাকগ্রেগরী ফিরে এলেন মারকুয়েশাস্ দ্বীপ থেকে মূল দ্বীপেতাহিতির রাজধানী পাপীতিতে।
নিতান্ত ঘটনাচক্রই বলতে হবে, –জাহাজ ছাড়ার দিন-ছয়েক আগে ওঁর সামান্য জ্বর হল। তাহিতিতে ম্যালেরিয়া আছে; অধ্যাপক তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের শরণ নিলেন। ওঁর হোটেলের অনতিদূরে ডক্টর ওয়াটকিন্স-এর চেম্বারে গিয়ে হাজির হলেন এবং ঘরে ঢুকেই জ্বরের কথা ভুলে গেলেন।
হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু, স্যার?
ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর আহ্বান কানে গেল না অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীর। প্রাচীরে। বিলম্বিত একটি তৈলচিত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, ডক্টর! এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন? এ কার আঁকা?
শিল্পীকে চিনবেন না। খ্যাতনামা কেউ নয়। আমার একজন পেসেন্ট ছিলেন।
–ছিলেন? এখন তিনি কোথায়? কি নাম ওঁর?
–ওঁর নাম পল গগ্যা। মারা গেছেন।
অধ্যাপক নির্নিমেষ নয়নে দেখছিলেন তৈলচিত্রটি। একটি নিসর্গ দৃশ্য। পশ্চাৎপটে কালো মেঘ আর পাহাড়। দু-একটি নারকেল গাছ, একটি কুঁড়ে ঘর। চওড়া একটা পথ এঁকেবেঁকে সরু হতে হতে পাহাড়ের কোলে হারিয়ে গেছে। টুপি-মাথায়, বাঁকাঁধে একজন স্থানীয় মালবাহী মেহনতি মানুষ দর্শকের দিকে পিছন ফিরে চলেছে ঐ অরণ্যমুখো। দর্শকের দিকে সে পিছন ফিরেছে; তার একলা চলার পথে শুধু অরণ্য আর পর্বত-সামনে সূরযকরোজ্জ্বল এক উপত্যকা। কাঁধের ভারে লোকটা নুয়ে পড়েছে।
-আপনার কি কোন অসুখ করেছে? ডক্টর ওয়াটকিন্স-এর প্রশ্ন।
–তা করেছে। জ্বর। কিন্তু সে কথা পরে। আপনি ঐ চিত্রকর সম্বন্ধে যা জানেন তাই আগে বলুন। তাতেই হয়তো আমার জ্বর ছেড়ে যাবে।
অধ্যাপক তার তাহিতি আগমনের কারণ অতঃপর জানান। ডক্টর ওয়াটকিন্স শুধু কুইনাইন দিলেন না, –পল গগ্যার শেষ জীবনের একটি বিচিত্র কাহিনীর সুগার-কোটও দিলেন। অদ্ভুত সে কাহিনীঃ
ডক্টর ওয়াটকিন্স পাপীতিতে প্র্যাকটিস করছেন আজ ত্রিশ বছর। একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি আছে তার। তাতেই রুগী দেখতে যান। বছর পাঁচেক আগে একবার মারকুয়েশাস্ দ্বীপ থেকে তার ডাক এল। টারাভাও গ্রামের মোড়লনীর অসুখ। সমুদ্র পার হয়ে ঐ। গ্রামে যেতে হয়। ওরা একটা এক-ঘোড়ায় টানা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। নৌকো ছেড়ে সাত-আট মাইল ঘোড়ার গাড়িতে পাড়ি দিয়ে ডাক্তার সাহেব টারাভাও গ্রামে এসে। পৌঁছলেন। ডাক্তার সাহেব ভাল কথক। টারাভাও গ্রামের বৃদ্ধা মোড়লনীর স্থলকায় দেহ, তার প্রকাণ্ড খাটখানা, তার পাতায় ছাওয়া ঘর, চুরুট খাওয়ার নিখুঁত বর্ণনা দিলেন। রোগী দেখা শেষ হলে ওরা ডাক্তার সাহেবকে পাশের ঘরে নিয়ে এল। সেখানে তার আহারের আয়োজন হয়েছে। সাহেব মানুষের জন্য একটা চারপায়া টেবিল আর টুলের ব্যবস্থাও ওরা করেছিল–না হলে ওরা সচরাচর মাটিতে বসেই খায়। কাঁচা মাছ, কঁকড়া কঁচকলা ভাজা, ঝলসানো মুরগী আর নারকেলের একটা তরকারী। এলাহী আয়োজন। ডাক্তার সাহেব আহার করতে করতেই লক্ষ্য করেন বছর সাতেকের একটা ছোট মেয়ে বারে বারে সে ঘরে ঢুকতে চাইছে, আর সকলে তাকে বারে বারে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট মেয়েটির মাজায় বাঁধা ন্যাকড়াটা শতছিন্ন এবং ধূলি-ধূসরিত। মাথার চুলগুলো জটা পাকানো। ও কি ভিখারীর মেয়ে? ভিক্ষা চাইছে? আহারান্তে গাড়িতে চড়বার সময়ও ডাক্তার সাহবের নজর পড়ল মেয়েটির দিকে। ডাগর চোখ মেলে সে তাকিয়ে আছে ওঁর দিকে। সবার ধমকে আর কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। ডাক্তার সাহেব পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে ওকে দিতে গেলেন, মেয়েটি নিল না। দু হাতে মুখ ঢেকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইল।