এঁরা বলেছিলেন, কিন্তু জোড়াসাঁকোর রবিবাবু অথবা টাকীর জমিদার যতীন্দ্রনাথ কি এতটা হেঁটে যেতে পারবেন? হাজার হোক ওঁরা হলেন—
সুরেন্দ্রনাথ বলেন, যা বলেছেন তা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবেন না! রবিবাবু কি যতীনবাবু যদি একথা শুনতে পান তবে রাগ করে এখনই ফিরে যাবেন। রসুল সাহেবকে আমরা গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছি এজন্য যে, তিনি আজ সভাপতি। ওঁর বদলে বরিশাল শহরের কোন গাড়োয়ান সভাপতি হলে তাকেই আমরা গাড়ি করে নিয়ে যেতাম; রসুল সাহেব হেঁটে যেতেন।
শোভাযাত্রা এগিয়ে চলে। সভাপতির গাড়ির পিছনেই আছেন সুরেন্দ্রনাথ। অমৃতবাজারের সম্পাদক মতিলাল আর ভূপেন্দ্রনাথ বসু। তার পরের সারিতে বিপিনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ আর ব্রহ্মবান্ধব। এমনি করে এক এক সারিতে তিনজন। পিছনে বন্দেমাতরম্ ব্যাজ পরিহিত স্বেচ্ছাসেবক দল। আর শোভাযাত্রার সবশেষে চলেছেন তিনজন–অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির সভাপতি কৃষ্ণকুমার মিত্র, ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ, আর হাওড়া হিতৈষীর সম্পাদক গীতি কাব্যতীর্থ। দীর্ঘ শোভাযাত্রা, এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায় না। শোভাযাত্রা হাবেলী থেকে রাস্তায় পড়ে–শোভাযাত্রার মাথা পথের বাঁকে হারিয়ে যায় । কিন্তু বন্দেমাতরম্ ব্যাজ পরা স্বেচ্ছাসেবকের দল যেই রাস্তায় পড়েছে অমনি একজন লালমুখো বললে–চার্জ!
শুরু হল লাঠি চার্জ! এলোপাথাড়ি মার। বড় লাঠির প্রহার, ব্যাটন নয়। লাঠি চার্জের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শোভাযাত্রায় কেউ বন্দেমাতরম ধ্বনি দেন নি। সেই হাবেলী মাঠে যা দেওয়া হয়েছিল তাই প্রথম, তাই শেষ। কিন্তু যষ্টি প্রহার শুরু হতেই সহস্র কণ্ঠে ওরা ধ্বনি দিয়ে ওঠে বন্দেমাতরম্।
বটুকেশ্বরের পাশেই ছিল সুশীল। লাঠি চার্জ শুরু হতেই শোভাযাত্রার লাইন ভেঙে গিয়েছিল। বটুক হাত বাড়িয়ে চেপে ধরে সুশীলের কামিজ। বলে–এই হাঁদা! রাস্তা ছেড়ে রকে উঠে দাঁড়া। ওখানে থাকলে মাথা ফেটে যাবে। টানতে টানতে ওকে নিয়ে আসে রাস্তার ধারে। দু-পাশের বাড়ির দরজা জানালা দুড়দাড় করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা পাকা বাড়ির রকে উঠে দাঁড়াল বটুক ঠেলে তুলল সুশীলকে। কিন্তু ও কী?
পুলিসের লাঠি চার্জ শুরু হতেই মিছিলের সারি বাঁধা শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। উঁচু রকের উপর দাঁড়িয়ে ও দেখতে পেল লাঠি পেটার বীভৎসতা। ঐ পড়ে গেলেন ফণীবাবু,-ফণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেচারাম লাহিড়ীর কাঁধে নামল একটা লাঠি! আর সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা নবশক্তির মনোরঞ্জনবাবুর ছেলে চিত্তরঞ্জন গুহ ঠাকুরতার। লাঠির ঘায়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন রাস্তার ধারের একটা পুকুরে। উদ্যত লাঠি মাথার উপরে দেখেও তিনি আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন নি। শুধু চিৎকার করে বলেছিলেন বন্দেমাতরম্।
বটুক বললে-চিত্তদা কি ডুবে মারা যাবে নাকি?
জবাব না পেয়ে পাশে ফিরে দেখে সুশীল তার পাশে নেই। সে ঐ রাস্তায় নেমে পড়েছে আবার। পুলিসের পায়ের ফাঁক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে রাস্তার পাশে–যেখানে পুকুরের জলটা লাল হয়ে উঠেছে চিত্তরঞ্জনের রক্তে। আর যেখানে তার দেহটা এইমাত্র ডুবে গেল।
বটুক কি করবে স্থির করে উঠতে পারে না। কর্তব্যবুদ্ধি বলছে এখন তাকেও যেতে হবে রাস্তার ওপারে–ঐ যেখানে আহত মানুষটার দেহ ডুবে গেল পুকুরের জলে, কিন্তু শুভবুদ্ধি ওর পা-দুটি বেঁধে ফেলেছে এই নিরাপদ মালভূমিতে! ওর চোখের সামনেই আবার লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়লেন ব্রজেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী মশাই। দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল বটুকেশ্বর।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললে সে।
হাঙ্গামা মিটে গেলে বাড়ি ফিরে এল বটুকেশ্বর। একটা প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে ভরে গেছে তার অন্তঃকরণ। নাঃ! স্বদেশবান্ধব সমিতির সভ্য হওয়ার মত মনের জোর তার। নেই। দীননাথ ওকে বন্ধ করে রাখলেন ঘরের ভিতর। শিকল তুলে দিয়ে। কোন প্রতিবাদ করে নি বটুক। ও বুঝেছে, এ পথ ওর নয়। চমরমুহূর্তে আতঙ্কে ও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। চিত্তরঞ্জন গুহ ঠাকুরতাকে ও দাদা ডাকে। তাঁর বাবা ব্ৰতীসমিতির মনোরঞ্জনকে জেঠামশাই বলে। ওঁরা তার আপনজন। তবু ঐ চিত্তরঞ্জনকে বাঁচাবার। জন্য মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে সে এগিয়ে যেতে পারে নি। অথচ সুশীল? ওর চেয়ে বয়সে অন্তত তিন-চার বছর ছোট হবে। চোদ্দ-পনের বছরের কিশোরমাত্র। সে চিত্তরঞ্জনদাকে চেনে না। তার চোখে সে দেখেছিল একজন বিপন্ন দেশবাসীকে! লজ্জায় অনুশোচনায় বটুক সমস্ত দিন পড়ে থাকল তার ঘরের মধ্যে। খবর পেল ক্রমে ক্রমে। চিত্তরঞ্জন ডুবে মারা যান নি। পুলিস সুপার একমাত্র সুরেন্দ্রনাথকেই গ্রেপ্তার করেছিলেন। আরও শুনল, পুলিস যখন সুরেন্দ্রনাথকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সনের বাড়িতে নিয়ে গেল তখন তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন মহাত্মা অশ্বিনীকুমার, বিহারীলাল রায় আর ভারতীয় সম্পাদক। কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদাঁ। ম্যাজিস্ট্রেট সরাসরি বিচারে বে-আইনী শোভাযাত্রা পরিচালনার দোষে সুরেন্দ্রনাথকে দুশ টাকা জরিমানা করলেন। সুরেন্দ্রনাথ একখানা চেয়ারে বসতে উদ্যত হয়েছিলেন বলে আদালত অবমাননার দায়ে তাঁর আরও দুশ টাকা জরিমানা হল। গ্রেপ্তারের সময় সুরেন্দ্রনাথ ভূপেন্দ্রনাথ বসুকে সম্মেলনের কাজ চালিয়ে। যেতে বলেছিলেন। সভা যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। অশ্বিনীকুমার ও অমৃতবাজারের সম্পাদক ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করেন। সভাপতি রসুল সাহেব বলেন, ধর্ম যাই হোক, আজ হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান সহযাত্রী।