আমি দ্বৈপায়নদাদুকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, আপনার গল্প কি এখনও শেষ হয়নি?
তুমি কি ভেবেছিলে, শেষ হয়ে গেল সব কথা?
-তাই তো ভেবেছিলাম। বটুকেশ্বর দেবনাথ বরিশালে ফিরে গেলেন, গগন পাল দেশত্যাগী হলেন আর ভান গর্গ উন্মাদ অবস্থায় আত্মহত্যা করলেন–এরপর আর বাকি থাকল কে?
বাকি থাকল দ্বৈপায়ন লাহিড়ী। ভূষণ্ডী কাকের মত আশী বছর বয়সে সে আজও টিকে আছে।
আমি লজ্জা পাই।
দ্বৈপায়নদাদু কিন্তু থামলেন না, বলে চলেন, শিল্পীর শেষ আছে, শিল্পের শেষ নেই। গল্প আমার শেষ হয়নি। বটুকেশ্বরের সঙ্গে তার শেষদিন পর্যন্ত আমার পত্রালাপ অব্যাহত ছিল। বরিশাল থেকে মাঝে মাঝৈ তার চিঠি পেতাম। তার পরিবারে ফিরে গিয়েছিল সে। বাপ-মা তাকে গ্রহণ করেছিলেন। সে আর বিবাহ করেনি কোনদিন। সুলেখাকে সে ভুলতে পারেনি সারাজীবন। মহাজনী কারবারে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল। ছবি আর কখনও আঁকেনি সে। দেশ স্বাধীন হবার আগেই সে মারা যায়। বরিশালেই।
গগ্যার খবরও আর পাইনি। একটি বিদেশী জাহাজে খালাসীর কাজ নিয়ে সে কোন্ সুদূরে পাড়ি জমায় এটুকু জেনেছিলাম। তারপর আর বিশ-ত্রিশ বছর তার খবর রাখিনি। তবু অদ্ভুতভাবে গগনের শেষজীবনের কাহিনীটা আমার গোচরে এল। অনেক অনেক দিন পরে। সেটা বোধহয় উনিশশো তিপ্পান্ন সাল। হঠাৎ বিলাতি ডাকটিকিট দেওয়া একটা খাম এল আমার নামে। অভাবনীয় ব্যাপার! চিঠিখানা লিখেছেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একজন মার্কিন ভদ্রলোক-প্রফেসর রবার্ট ম্যাকগ্রেগরী। একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিস। সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। মার্কিন মুলুকের একজন বিশ্ববিশ্রুত কলারসিক–আর্ট-কনৌসার। লিখেছেন–নিতান্ত ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছি আপনার সঙ্গে মিস্টার গগন পাল আর্টিস্টের পরিচয় ছিল। গগনবাবুর পুত্র, বর্তমানে ঢাকা-নিবাসী মিস্টার আর. জি. পাল অ্যাডভোকেট আমাকে জানিয়েছেন যে, আপনি তার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এ কথা যদি সত্য হয় তাহলে অনুগ্রহ করে শিল্পীর বাল্যজীবন সম্বন্ধে আপনার যেটুকু জানা আছে তা আমাকে জানাবেন কি? তাঁর শিল্পকর্ম কোথায় দেখতে পাওয়া যেতে পারে তাও জানাবেন। আপনার উত্তর পেলে কলকাতাস্থিত আমেরিকান কনস্যুলেটকে আমি অনুরোধ করব আপনার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে।
আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। গগন পালের বাল্যজীবন সম্বন্ধে ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্প-বিশারদ আগ্রহী! গগ্যার খবর তিনি কোথায় পেলেন? গগ্যার ছেলের সন্ধানই বা। তিনি জানলেন কেমন করে? বাবলু তাহলে অ্যাডভোকেট হয়েছে? সেই হাফ-প্যাডেল করা বাবলু! যাই হোক জবাবে আমি লিখলাম, -গগন পাল আমার সতীর্থ ও বন্ধু। তার জীবনের অনেক কিছুই আমি জানি। উনিশশো চব্বিশ সালে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি। তারপর সে কোথায় আছে আমি জানি না। তার শিল্পকর্মও কোথায় আছে তা আমার অজ্ঞাত। তবে তার আঁকা একটি অয়েলকালার আমার কাছে আছে। সেটা আমি নিলামে কিনেছিলাম।
ম্যাকগ্রেগরী পত্রপাঠ জবাব দিলেন, –আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার বন্ধু জীবিত নেই। তাঁর ছবিখানি আপনি কোনক্রমেই হস্তান্তরিত করবেন না। ঘটনাচক্রে আগামী মাসে এখান থেকে ওঙ্কারভাট, বরভুদর যেতে হবে আমাকে। সেই সময় ভারতবর্ষে যাবারও চেষ্টা করব। সম্ভব হলে আপনার সঙ্গে দেখা করব।
মাসছয়েক পরে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বছর পঞ্চাশ বয়স। বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারা। ইতিপূর্বে আরও দুবার ভারতবর্ষে এসেছেন! অজন্তা খাজুরাহো সাঁচি-মহাবলিপুরম চষে বেড়িয়েছেন। সৌজন্য-বিনিময়ের পরে বলেন, কই, নিয়ে আসুন আপনার বন্ধুর ছবিটা!
যখন আমি ছবিখানা দ্বিতলের ঘর থেকে নামিয়ে আনলাম তখন উনি সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত। আমি ছবিটা জানালার সিলের উপর রাখি; ভদ্রলোক কয়েক পা পিছু হটে এলেন। একদৃষ্টে ছবিখানা দেখতে থাকেন। নির্বাক নিস্পন্দ। না টানলে একটা সিগারেট আদ্যন্ত পুড়তে কতক্ষণ লাগে? অতটা সময় ছবিখানা দেখেছিলেন। যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন আঙুলে আগুনের ছেঁকা লাগায়।
য়ায়াম সরি! ইতিমধ্যে সিগারেটের লম্বা ছাই ঝরে পড়েছে মেঝের কার্পেটে। স্টাম্পটা অ্যাসট্রেতে ফেলে দিয়ে উনি দ্বিতীয় একটি সিগারেট ধরান। আমার দিকে ফিরে বলেন, আপনি কি এই ছবিটা বিক্রি করতে সম্মত? আপনি চিঠিতে লিখেছিলেন এটি আপনি নিলামে কিনেছেন–এ কোন উপহার নয়; তাই প্রশ্ন করছি।
–এ ছবি নিয়ে আপনি কি করবেন?
–কোন একটি সংগ্রহশালায় রাখব।
আমি বলি, প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী, আমার বন্ধু এ দেশে তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। এ ছবিটি অতি অল্প দামে কিনেছিলাম আমি। আপনি যদি একে কোন বিখ্যাত সংগ্রহশালায় রাখতে চান আমি বাধা দেব না। আপনি এখানা নিয়ে যান।
কত দাম দিতে হবে?
আমি হেসে বলি, –আমি ছবির কি বুঝি? আপনি আর্ট কনৌসার। এ ছবির ন্যায্য দাম যা হওয়া উচিত তাই দেবেন।
কৌতুক উপচে পড়ে অধ্যাপকের চোখ দুটিতে। বলেন, বর্তমানে আমি আর্ট কনৌসার নই, সামান্য খরিদ্দার মাত্র। আপনি ছবিটি নিলামে কিনেছেন, তাই ন্যায্য দর না জানলেও ওর বাজার-দরটা আপনি জানেন!
শিল্পীরা আত্মভোলা হয়। শিল্প-বিশারদরা সে জাতের নয় তাহলে।