না, না, না! সে দুর্ঘটনা ঘটতে দেবে না ভিন্সেন্ট! কিছুতেই নয়!
সূরয তুমি আমাকে ক্ষমা কর। বিশ্বাস কর, মরতে আমি চাইনি, মরতে আমি চাই! কিন্তু আমার উপায় নেই। ডান হাত অন্যায় করলে তাকে আমি শাস্তি দিতে পারি– কিন্তু মনকে আমি ধরব কোন্ প্রদীপ শিখায়? তাই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবার আগে আমি সজ্ঞানে নিজে হাতে টেনে দিতে বাধ্য হলাম এ-জীবনের যবনিকা! মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, গোইয়ার মত পরিণত বয়সে শিল্পসৃষ্টি করার ভাগ্য নিয়ে আমি আসিনি। ক্ষতি কি তাতে? রাফাইল তো সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই অমর হয়ে আছেন। আমিও তাই থাকব।
বিদায় সূরয! বিদায় পৃথিবী!
যথানিয়মে সকালবেলা সেজেগুজে গরম জামা পরে বালখিল্যের দল এল পাগলাকে খেপাতে। কিন্তু ছড়া কাটার সুযোগ পেল না তারা। আজকের লুকোচুরির খেলায় পাগলা তাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। প্রতিবেশীর সেই সাত বছরের ছেলেটা–যাকে বাঁচাতে ভিন্সেন্ট এই শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই প্রথম আবিষ্কার করল তার দেহটা। চিৎকার করে উঠল সে।
বারান্দার উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে ভিন্সেন্ট। মাথাটা ঝুলছে বারান্দার ধার থেকে। আর ঝুলে পড়েছে তার বিশ্বাসঘাতক ডান হাতখানা। সেই হাতের একটা শিরা পেন্সিল কাটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলছিল ভিন্সেন্ট। রক্তের ধারা নেমে এসেছে সান বাঁধানো মেঝে থেকে সিঁড়িতে বাগানের ফুলে-ভরা সূরযমুখী ফুলের গাছগুলোর দিকে বিসর্পিল রেখায়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে সে লুটিয়ে পড়েছে মেঝের উপর। মাঘের শীতে তার শরীর হিম হয়ে পড়ে আছে!
তবু দুর্জয় তার প্রাণশক্তি! এর পরেও তিনদিন বেঁচে ছিল। খবর পেয়ে দিল্লী থেকে আবার ছুটে এসেছিল ওর ছোটভাই সূরযভান।
দেড়দিন পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ভিন্সেন্ট দেখতে পেল তাকে। স্নান হাসল ভিন্সেন্ট। অস্ফুটে বললে, –আশ্চর্য সূরয! যখনই তোর জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠেছে তখনই চোখ মেলে দেখি তুই বসে আছিস! সেই কান কাটার দিনটার কথা মনে আছে সূরয?
শেষ বারো ঘন্টা সূরয একাই বসে ছিল মৃত্যুপথযাত্রীর শয্যাপার্শ্বে।
শিশুদৈত্যের দল আর ছড়া কাটতে আসেনি। তারাও ওকে মুক্তি দিয়েছিল। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল ভিন্সেন্ট কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞান ছিল তার। সূরযকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিল? দুঃখ করিস না রে! এই ভাল হল! এ ছাড়া পথ ছিল না!
উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সূরয। প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায়নি।
–আমার ছবিগুলো সব যত্ন করে রেখে দিস! বিশ্বাস রাখিস্যাবার আগে বলে গেলাম–একদিন না একদিন ওর দাম পৃথিবীকে কড়া-ক্রান্তি হিসাবে মিটিয়ে দিতে হবে!
সূরয ওর হাতখানা ধরে শুধু বলেছিল, চুপ কর, দাদা!
-এখনই চুপ করব রে। শুধু একটা কথা কানে কানে বলে যাই। এ আমার অন্তিম ইচ্ছা। তোর ছেলে হলে তার নাম রাখিস ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। আমি আবার ফিরে আসব; তোর ছেলে হয়ে জন্মাব, নামটাও তাই রাখিস।
সূরয ওর হাতখানা ধরে শুধু বলেছিল, চুপ কর, দাদা!
প্রদীপ নেববার আগে একবার শেষবারের মত দপ্ করে জ্বলে ওঠে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তেমনি হঠাৎ উঠে বসতে চেয়েছিল ভিন্সেন্ট। শূন্য দ্বারপথে সে কোন অপার্থিব মূর্তি দেখতে পেয়েছিল। বললে, –ঐ, ঐ ওরা এসেছে।
সূরয সচকিত হয়ে দ্বারের দিকে তাকায়। কেউ নেই সেখানে। ভিন্সেন্ট চিৎকার করে ওঠে, কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?..শিবলোক, বৈকুণ্ঠ? ওসব আমি বিশ্বাস করি না। না, আমি যাব না!…এরা আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে তাতে তোমাদের কি?…হা হা, কতবার বলতে হবে?…আমি এই পৃথিবীতেই আবার জন্মাতে চাই। আবার এই নরক যন্ত্রণা সইতে চাই সর্বাঙ্গ দিয়ে!…তাতে তোমাদের কি? ঐ সূরযের বৌয়ের কোলে ফিরে আসব আমি! যাব না! না, আমি কিছুতেই যাব না তোমাদের সঙ্গে!
এই তার শেষ কথা।
যাব না, যাব না, বলতে বলতেই চলে গেল সে!
কাহিনী শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলে দ্বৈপায়নদাদু।
বুঝতে পারি, বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। চোখ থেকে চশমাটা খুলে কঁচটা মুছতে মুছতে বলেন, নরেন, তুমি কি ভান গর্গের জীবনী লিখবে, না উপন্যাস?
না, জীবনী নয়, উপন্যাসই লেখবার ইচ্ছে আছে আমার। কেন বলুন তো?
–তাহলে এবার যে কথাটা বলছি সেটা তোমার বইতে লিখ না। ভিন্সেন্টের শেষ ইচ্ছাটাও করুণাময় পূরণ করেনি! ভিন্সেন্টের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারেনি সূরয। সে উন্মাদ হয়ে যায়। মাত্র ছ মাসের মধ্যে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় সে মারা যায়। ওর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তার চিতাভস্ম নিয়ে এসে ভিন্সেন্টের কবরের পাশে প্রোথিত করে। দুই ভাইয়ের সমাধিক্ষেত্রে একটি আইভিলতা রোপন করে দেয়। তাই বলছিলাম, ভিন্সেন্ট ভান গর্গের নামটা পর্যন্ত টিকে থাকতে দেননি ঈশ্বর।
আমি অবাক হয়ে বলি, –একথা আমার বইতে লিখতে বারণ করছেন কেন?
কারণ তোমার পাঠক হয়তো বিশ্বাস করবেন না-টুথ ইস স্ট্রেঞ্জার দ্যান। ফিকশান; ভাববেন ছ মাসের মধ্যে সূরযের উন্মাদ অবস্থায় মৃত্যুটা সাহিত্যের বিচারে করুণরসের একটা ওভারডোস! যদি জীবনী লিখতে তাহলে কোন কথা ছিল না–কারণ ভিন্সেন্ট ভান গর্গের ভাইয়ের এটাই হচ্ছে সত্য ইতিহাস।
.
১৬.
এরপর দীর্ঘ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ব্যবধান দিয়ে শুরু করি–