ভিন্সেন্ট ছবি আঁকে আত্মহারা হয়ে। তৎক্ষণাৎ সে নিয়ে বসে রঙ-তুলিক্যানভাস। সর্বনিম্ন স্তরের ছবিখানা তখনই আঁকতে বসে। অশীতিপর বৃদ্ধ ভিন্সেন্ট ভান গর্গের সম্বর্ধনাসভার চিত্র। সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছেন শিল্পী, সকলের স্বীকৃতি পেয়েছেন, শ্রদ্ধা পেয়েছেন বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে!
কিন্তু ওরা কি দেবে অনাগত ভবিষ্যতের সে রঙিন কল্পনায় মগ্ন হতে? ভবিষ্যতের সাফল্যকে পিছন থেকে টেনে ধরে বর্তমানের বিদ্রূপঃ
কানকাট্টা কানকাট্টা ডান কানটা কই?
কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?
একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায় বারে বারে। বারান্দায় বেরিয়ে এসে হাত দুটি জোড় করে বলে, অন্তত একটা দিন আমাকে রেহাই দাও ভাই! আজ আমাকে একটা ছবি আঁকতে দাও! কাল এসে আমাকে খেপিও; আমি কিছু বলব না!
ওরা হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।
–পাগলা ছবি আঁকবে রে! গর্গমশাই করছ তুমি কি? এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি।
হতাশ হয়ে ফিরে আসে ভিন্সেন্ট। জানালাটা বন্ধ করে দেয়। যতটা এড়ানো যায় ঐ মর্মভেদী শব্দ! কিন্তু জানালা বন্ধ করলে আলোও কমে যায়। সু উপায় নেই।
সমস্ত দিন ধরে ভিন্সেন্ট ছবি আঁকল। শেষ করল তার অশীতিতম জন্মদিনের চিত্র! সমস্ত দিনই ওরা ছড়া কাটল তীক্ষ্ণ স্বরে, পালা কবে। ভিন্সেন্ট স্বজ্ঞানে কিছু আঁকেনি। আচ্ছন্নের মত মন যা চেয়েছে তাই এঁকে গেছে। ডান হাতের উপর তার অধিকার হারিয়ে গেছে যেন।
সন্ধ্যাবেলায় ছেলের দল ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেল। ভিন্সেন্টও ক্লান্ত হয়ে উঠে পড়ে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সমস্ত দিনমান যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। যেন আজই তার অশীতিতম জন্মোৎসব পালন করা হল। যেন সারাটা দিনমান ওর অন্ধ ভক্ত আর স্তাবকের দল বাইরের বাগানে ওর জয়ধ্বনি দিয়েছে। এখন উৎসব-শেষে শ্রান্তদেহে ও বিশ্রাম খুঁজছে।
লণ্ঠনটা জ্বেলে নিয়ে সরযূপ্রসাদ ঢুকল ঘরে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে বাইরে। হঠাৎ লণ্ঠনটা তুলে ধরে সরযূপ্রসাদ সদ্য সমাপ্ত ছবিখানা দেখল। ওর মহোত্তম শিল্পের প্রথম দর্শক। ভিলেন্ট অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। সরযু কী বলে শুনতে হবে। অনেকক্ষণ ছবিটা নিরীক্ষণ করে অবশেষে সরযূপ্রসাদ তার মতামত প্রকাশ করে, ইয়ে বুঢ়া রোতে কেঁও?।
— রোতে কেঁও? কাঁদছে? কে? সাফল্যের আনন্দে অশীতিপর বৃদ্ধ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ কি কেঁদে ফেলেছেন? অসংখ্য ভক্ত আর স্তাবকের মাঝখানে সে অশীতিতম জন্মদিনে বৃদ্ধ ভান গর্গের চোখে আনন্দাশ্রু এঁকেছে নাকি? ভিন্সেন্ট জবাবে বলে, দূর বোকা! কাঁদবে কেন? ও তো হাসছে! দ্যাখ না ভাল করে
-আপ দেখিয়ে না?
আলোটা উঁচু করে ধরে সরযুপ্রসাদ।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভিন্সেন্ট। যেন ছবিটা এই প্রথম দেখছে সে! কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! এ কী এঁকেছে ভিন্সেন্ট! কোথায় তার ভক্ত স্তাবকের দল? সেই বরণমালা হাতে, শঙ্খ হাতে, চন্দনের বাটি হাতে মেয়ের দল কোথায় গেল? এ ছবি কে এঁকেছে?
ক্যানভাস জুড়ে একটি মাত্র বৃদ্ধের ছবি। হাতলহীন চেয়ারে বসে আছে দু হাতে মুখ ঢেকে। নিরতিশয় ব্যর্থতায়, অপমানে ভেঙে পড়েছে বৃদ্ধ। পরনে তার কয়েদীর পোশাক। কয়েদী? না। ওটা উন্মাদাগারের সেই বিচিত্র নিকার-বোকার! বৃদ্ধ উন্মাদ দু হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদছে। ঘরে আর কেউ নেই, কিছু নেই! শুধু ধিকিধিকি জ্বলছে ফায়ার-প্লেসে ফেলে আসা জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার তুষানল!
একটা আর্তনাদ বের হয়ে এল সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ভিন্সেন্টের কণ্ঠনালী থেকে অশীতিপর ভিন্সেন্টের দুর্দশা সে সইতে পারল না!
সমস্ত রাত ঘুম এল না ভিন্সেন্টের। পায়চারি করে ফিরল বারান্দায়। এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? আজ সে সুস্থ সবল আছে, কিন্তু পূর্ণিমা আসতে আর মাত্র দিন সাতেক বাকি। তিন মাসের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এবার মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে সে কি করবে? উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে যাবে রাস্তায়? আত্মহারা হয়ে কি খুন করে বসবে প্রতিবেশীর ঐ সাত বছরের বাচ্চাটাকে? বিচিত্র নয়! সাতদিন পরে সে হয়তো ওদের বিদ্রুপে উন্মাদ হয়ে ছুটে বেরিয়ে আসবে বাগানে। ঐ ফুটফুটে বাচ্চাটা হয়তো ছুটে পালাতে পারবে না, হুমড়ি খেয়ে পড়বে লাল কাঁকরের রাস্তার উপর। আর বদ্ধ উন্মাদ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে তার উপর। হয়তো দুহাতে টিপে ধরবে ওর সরু কণ্ঠনালী, হয়তো উপড়ে নেবে ওর চোখ দুটো, হয়তো–আঃ!
-ঈশ্বর! এ কী করলে তুমি? আমি শিল্পী হতে চেয়েছিলাম! তুমি আমাকে নররাক্ষস করে তুলেছ!
না না! ঈশ্বর নেই! ঈশ্বরকে অভিশাপ দিয়ে লাভ নেই! সে একটা ব্যাধিতে ভুগছে। সাতদিন পরে নিজের উপর তার কোন অধিকার থাকবে না। সে কী করবে, কী বলবে সে জানে না। আজই বা তাই জানে নাকি? এই যে সারাটা দিনমান সে যে ছবিখানা এঁকেছে, তা কি স্ব-ইচ্ছায়? এখন তো সে উন্মাদ নয়, তবু তার ডান হাতখানা তো স্বেচ্ছাচারিতা করে গেছে, নির্বিচারে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে আঁকতে চেয়েছিল তার পরিণত জীবনের সাফল্যের চিত্রতার ব্যভিচারী হাত এঁকে বসল চরম ব্যর্থতার ছবি! শিল্পী যদি নিজের ইচ্ছানুসারে শিল্পসৃষ্টি করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে তবে তার বেঁচে থাকার কী অর্থ? এর পর স্বেচ্ছাচারী ডান হাতখানা তার নির্দেশ অমান্য করে হয়তো এমন সব ছবি এঁকে যাবে–যা সে আঁকতে চায় না, যার বিষয়বস্তু তার অন্তরের নির্দেশে রূপায়িত নয়! লোকে বলবে, ভান গর্গের ভীমরতি হয়েছে–এত নিম্নস্তরের ছবি সে এঁকেছে? আলুর ভোজ, সিঙারণের সেতু, জোড়-জাঙাল গীর্জা, সূরযমুখী, পোস্টম্যানের আলেখ্য, পাগলাগারদের প্যারেডের দৃশ্য এঁকেছে যে হাত, সেই হাতই এমন অশ্লীল কদর্য ছবি আঁকতে পারে!