‘–বাঁ কানটাও দে না কেটে খেতে দেব দই!’
দই খাওয়ার লোভে নয়, ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লোভে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দ্বিতীয় কানটাও ওদের ছুঁড়ে দেয়! তাহলে কি থামবে ওরা? সত্যিই থামবে? পালিয়ে যাবে ওর ঘরের সামনে থেকে? যেমন করে পালিয়ে গিয়েছিলেন মিসেস ডেভিডসন?
‘–কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?’
সংযমের সব বাঁধন ভেঙে যায়। দুরন্ত ক্রোধে দরজা খুলে হঠাৎ বেরিয়ে আসে ভিন্সেন্ট। ওদের তাড়া করে ধরতে যায়। ওরাও ছুটে পালায়। চিৎকার করে ওঠে, — পাগলা ক্ষেপেছে রে!
ছুটতে ছুটতে চলে যায় ওর নাগালের বাইরে। সেখান থেকে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। দ্বিগুণ উৎসাহে ওখান থেকে আবার ছড়া কাটে।
–কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?
রাগে অপমানে ভিন্সেন্ট থরথর করে কাঁপতে থাকে।
হঠাৎ একটা আধলা ইট এসে লাগে ওর মাথায়।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ধুলোর উপর। দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ভিন্সেন্ট। আরও কয়েকটা ঢিল এসে পড়ে-মাথায়, মুখে, পিঠে। ভিন্সেন্ট। কী করছে জানে না। সে ধুলোর উপরেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দু হাত উর্দ্ধ আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে ওঠে, –হে ঈশ্বর! আমাকে সত্যিই পাগল করে দাও তুমি!
পরক্ষণেই ওর সম্বিৎ ফিরে আসে। এ কী করল সে! সে না নাস্তিক? সে না ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী? আজ মর্মান্তিক যন্ত্রণায় সব ভুল হয়ে গেল তার। না! ভিন্সেন্ট ভান গর্গ যোসেফ মুর্মু নয়! হার সে মানবে না! আবার উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে ফিরে যায় তার ঘরের দিকে।
অমনি গুটিগুটি এগিয়ে আসে বালখিল্যের দলঃ
গর্গমশাই, গর্গমশাই করছ তুমি কি?
এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি!
বন্ধু ছিল নাকটা তাহার কাটতে গিয়েছি।
কচাৎ করে ভুলেই নিজের কানটা কেটেছি!
.
পরদিন ভিন্সেন্ট বসেছিল একখানা সেলফ-পোর্ট্রেট আঁকতে। আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে আঁকবে। নিজের মুখটা দেখেই মনটা খিঁচড়ে যায়। ডান কানটা কাটা! কানকাটা সেপাই! ক্ষণিক উন্মাদনায় সে নিজেই নিজের কান কেটেছে। সে লজ্জার কথা দুনিয়া ভুলে যাবে দুদিন পরে–যেদিন মাটির তলায় ওরা শুইয়ে দেবে ব্যর্থ-আর্টিস্ট ভান গর্গকে। কিন্তু একথা তো নিশ্চিত যে, একদিন পৃথিবী নতমস্তকে স্বীকার করবে তার সৃষ্টিকে। আজ সে যদি সেলফ-পোর্ট্রেট আঁকে তাহলে ওর লজ্জার ইতিহাসটাও শাশ্বত হয়ে থেকে যাবে পৃথিবীতে। সে ভুল ও করবে না। নিজের ছবি সে আর আঁকবে না। আচ্ছা, কতদিন বাঁচবে সে? তা কে বলতে পারে? মিকেলাঞ্জেলো বা তিশান নব্বই বছরের কাছাকাছি বেঁচে ছিলেন। ক্লোদ, গোইয়া, কোরো আশী বছরের চেয়েও বেশিদিন এঁকে গেছেন ছবি। প্রথম দরের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে মারা যান রাফাইল, মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে। অর্থাৎ ভিন্সেন্টের বর্তমান বয়সে। কিন্তু এত কম বয়সে নিশ্চয় মারা যাবে না সে! মৃত্যুর পদধ্বনি এখনও শোনা যাচ্ছে না। অনেক দূরে সে দিন। দশ-বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ বছর! অনেক, অনেক ছবি আঁকতে হবে ইতিমধ্যে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিত্রকরের ছবির পাশে থরে থরে একদিন সাজানো হবে সেসব ছবি। আচ্ছা, সেই পরিণত বয়সে ভিন্সেন্টকে কেমন দেখতে হবে? দাড়িওয়ালা লিওনার্দোর মত, না কি তোবড়ানো গাল মিকেলাঞ্জেলোর মত?
হঠাৎ ওর মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেল। নিজের প্রতিকৃতি তো সব বড় জাতের আর্টিস্টই এঁকেছেন! লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, রেমবান্ট, মায় গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল পর্যন্ত সেলফ-পোর্ট্রেট এঁকেছেন দর্পণে প্রতিবিম্ব দেখে। ভিন্সেন্ট নূতন কিছু করবে। মনের মুকুরে সে দেখবে অনাগত ভবিষ্যতে নিজের পরিণত রূপ! আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর পরে ওর অশীতিতম জন্মদিনে ওকে কেমন দেখতে হবে তাই ফুটিয়ে তুলবে রঙে আর রেখায়। ততদিনে সে নিশ্চয়ই স্বীকৃতি পাবে।
কল্পানায় ভিন্সেন্ট দেখতে থাকে ছবিটা। ভিন্সেন্টের অশীতিতম জন্মোৎসবে সমবেত হয়েছেন দেশের জ্ঞানীগুণী শিল্পীবৃন্দ। মাঝখানে একটা পিঠ-উঁচু ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে বসে আছেন জ্ঞাননিধূর্তকল্মশ অশীতিপর ভান গর্গ; তার কপালে চন্দনের ফোঁটা, গলায় থরে থরে শ্বেতপদ্মের মালা। একপাশে ভক্তের দল সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে, আর পাশে কয়েকটি তরুণী এসেছে মাঙ্গলিকী নিয়ে। শঙ্খধ্বনি করছে, বরণ করছে, শ্রদ্ধার্ঘ্য নামিয়ে রাখছে। চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু ঐ জ্ঞানবৃদ্ধ শিল্পী! না! ছবিটা সে তিন ধাপে আঁকবে। তিনতলা ছবি। অজন্তার সপ্তদশ বিহারে অন্তরালের বাঁ-দিকের প্রাচীরে যেমন আছে বুদ্ধদেবের ত্রিতল চিত্র-সম্ভার। একতলায় সিংহাসনে আসীন বুদ্ধদেব। তাঁর দক্ষিণে রাজন্যবর্গ–বিম্বিসার, অজাতশত্রু, প্রসেনজিৎ, আর বামে শিষ্যের দল সারিপুত্র, মহা মোগল্ল্যায়ন, আনন্দ প্রভৃতি। দ্বিতলে দেখা যায় বুদ্ধদেব ত্ৰিত্রিংশস্বর্গের সোপান বেয়ে মর্তে নেমে আসছেন, আর ত্রিতলে সর্বোচ্চস্তরে অজন্তা শিল্পী এঁকেছেন স্বর্গের দৃশ্য। সুরসুন্দরী এবং দেবগণের মাঝখানে সদ্ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন গৌতম বুদ্ধ।…. ঐ রকম ত্রিতল চিত্রের মাধ্যমে ভিন্সেন্ট ভান গর্গ রেখে যাবে এক শাশ্বত কীর্তি–তার অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনের এক আলেখ্য। সর্বনিম্ন স্তরে শিল্পীর অশীতিতম জন্মোৎসব, দ্বিতীয় স্তরে ভিন্সেন্টের মৃত্যু! মাঝের ছবিটার কম্পোজিশান হবে অজন্তার উনবিংশতিতম গুহায় মহাপরিনির্বাণ বাসরিলিকের মত। অনুগ্রাহী ভক্তের দল হাহাকার করছে। আর সর্বোচ্চস্তরে দেখা যাবে, স্বর্গে একদল দেবদূত মেঘের উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। মর্তের দৃশ্য। তারা অপেক্ষা করছেন নূতন আগন্তুক অতিথির! তারা কারা?-ঐ লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, এল গ্রেকো, রেমব্রান্ট, রুবেন্স, ভেলাসকেথ, গোইয়া, মানে, মনে, দেগা… ।