সূরষের দাদা সেদিন সমস্তদিন একখানা ছবি এঁকেছিল!
নিজের কান নিজের হাতে কেটে ফেলার পর আরও তিন মাস বেঁচে ছিল ভিন্সেন্ট। তার প্রথম মাসটা কাটে হাসপাতালে। বাকি দু মাস আমার বন্ধুর বাড়িতে–ভগলু, রঘুবীর আর সরযুপ্রসাদের তত্ত্বাবধানে। ভিন্সেন্টের সারাটা জীবনই একটানা একটা ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। কোথাও সে দুদণ্ড শান্তি পায়নি। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে তরী ভিড়িয়েছে; টিকতে পারেনি–আবার ভেসে পড়েছে। কিন্তু শেষের এই দু মাস নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেদনাদায়ক।
রাঁচি তখন আর মোটেই ফাঁকা নয়। পশ্চিমের বায়ুবিলাসী ডেংচিবাবুর দল ক্রমাগত আসছেন। ভিন্সেন্টের বাড়ির আশেপাশে যেসব বাড়ি এতদিন তালাবন্ধ পড়ে ছিল একে একে তার দ্বার খোলা হল। কলরব-মুখরিত পুরুষ-নারী-শিশুর দলে ভরে গেল পাড়াটা। সকাল-বিকাল একঝাক প্রজাপতির মত তারা হাওয়া খেতে বার হয়। কখনও দল বেঁধে যায় হুডু, কখনও জোহা। এ তো আনন্দেরই কথা। কিন্তু কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! দুর্ভাগা ভিন্সেন্টের বরাতে ঐ কৌতুকপ্রিয় কলরব-মুখরিত আগন্তুকরাই দেখা দিল নিষ্ঠুররূপে। ইতিমধ্যে পাগল আর্টিস্টের মুখরোচক ইতিকথা পাড়ায় কারও জানতে বাকি ছিল না। ওর নাম হল কানকাট্টা!
ভিন্সেন্ট তার রঙ-তুলি ক্যানভাস নিয়ে বার হয় আর দূর থেকে চেঞ্জারবাবুদের কৌতুকপ্রিয় ছেলের দল ফেউ লাগে। হাততালি দিয়ে ওরা ডাকে, কানকাট্টা। এই কানকাট্টা।
ভিন্সেন্ট প্রথম প্রথম ভ্রূক্ষেপ করত না, মাথা নিচু করে দ্রুত-পায়ে পরিচিত পাড়ায় গণ্ডিটা অতিক্রম করে যেত। কিন্তু ও-পক্ষও নাছোড়বান্দা-তারাও পিছু পিছু চলতে থাকে পাড়া থেকে বে-পাড়ায়। ক্রমে সমস্ত শহর জেনে গেল কানকাট্টা সেপাইয়ের। মজাদার ইতিহাস! সবাই হাসে, কৌতুকবোধ করে। কখনও বয়ঃজ্যেষ্ঠ কেউ হয়তো বালকদলকে হাসতে হাসতে ভর্ৎসনা করে।
ভিন্সেন্ট রাগ করছে না, পাগলামোর কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখাচ্ছে না দেখে ছেলের দল হতাশ হয়। ওরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। দূর থেকে ঢিল মারে, ধুলো ছিটিয়ে দেয় পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ছুটে পালিয়ে যায়। নিরুপায় ভিন্সেন্ট ওদের সঙ্গে ভাব করবার চেষ্টা করে। ও যে পাগল নয় এটা প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে-ভাব জমাতে চায়, ছবি এঁকে দিতে চায়, গল্প শোনাতে চায়। কিন্তু শিশু দৈত্যের দল তাতে খুশি হয় না। আশাভঙ্গে তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। রাঁচিতে এসে পাগল দেখার আনন্দকে ওরা ছাড়বে কেন? ভিন্সেন্ট যেন বিশ্বাসঘাতকতা করছে–তার পাগলামিকে প্রচ্ছন্ন রেখে!
বাধ্য হয়ে আউট-ডোর পেইন্টিং বন্ধ করে দিল ভিন্সেন্ট। ঘরে বসেই আঁকতে শুরু করে। অবশ্য শীতকালেই আউট-ডোর ল্যাণ্ডস্কেপ জমে ভাল। কিন্তু উপায় কি? ওরা যে সত্যিই পাগল করে ছাড়বে তাকে।
তা ঘরের ভিতরেই কি শান্তিতে আঁকতে দেবে ছেঁড়াগুলো?
শিশুদলের মধ্যে কবিযশপ্রার্থী কেউ ইতিমধ্যে একটা ছড়া বেঁধে ফেলেছে। সাত সকালে ওরা এসে হাজির হয় বাড়ির আশেপাশে। ক্রমাগত ছড়া কাটেঃ
কানকাট্টা কানকাট্টা ডান কানটা কই?
কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?
কানটা নিয়ে ভাগল বুঝি!
বৃথাই তারে মরিস খুঁজি!
বাঁ কানটা দে না কেটে, খেতে দেব দই।
ভিন্সেন্ট বুঝতে পারে–এ শুধু শিশুর চাপল্য নয়, এর পিছনে পরিণত বয়সের ছাপ আছে। না হলে হঠাৎ পেত্নীর প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হত না। এই বালখিল্যদলের হাত থেকে কি করে নিস্তার পাওয়া যায়? সরপ্রসাদ, ভগলু অথবা রঘুবীর মাঝে মাঝে এসে ওদের তাড়িয়ে দেয়। ওরা ছুটে পালায়। আবার যেই ভগলুরা দূরে সরে যায় ওরা ঘনিয়ে আসে। হাততালি দিয়ে শুরু করে যৌথ-সঙ্গীত : কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?
দিবারাত্র এই ছড়া শুনতে শুনতে ভিন্সেন্টের মাথা ঝিমঝিম্ করে উঠত। ওর মনে। পড়ে যেত জোড়-জাঙালের সেই যোসেফ মুর্মুর কথা। যোসেফ মৃত্যুকে অস্বীকার করেছিল, যোসেফ মরতে চায়নি; তাই তার ভাগ্যবিধাতা তাকে এমন অবস্থার মধ্যে। এনে ফেলেছিলেন যখন মৃত্যুই তার একমাত্র কাম্য ছিল। আজ ভিন্সেন্টের অবস্থাও সেই রকম। মস্তিষ্কবিকৃতির সম্ভাবনাকে সে ঠেকাতে চেয়েছিল, সে পাগল হতে চায়নি আজ তার ভাগ্যবিধাতা তাকে এমন অবস্থায় পেড়ে ফেলেছেন তার মনে হচ্ছে ঐ। বালখিল্যদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র উপায় সত্যি পাগল হয়ে যাওয়া। তখন আর ওদের বিদ্রূপ তার গায়ে লাগবে না।
–কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?
আর তো পারা যায় না! ভিলেন্ট দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। দু হাতে কান চেপে । ধরে বসে থাকে। এ কী বিড়ম্বনা! শিশুর দল কী অপরিসীম নিষ্ঠুরই না হতে পারে!
মাঝে মাঝে ওরা ছন্দ বদলায়। অন্য কোন শিশুকবি একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখে বৈচিত্র্যের সন্ধান করেছে বোধহয়। সেদিন ওরা হাততালি দিয়ে নতুন সুরে শুরু করেঃ
গর্গমশাই গর্গমশাই করছ তুমি কি?
এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি!
বন্ধু ছিল, নাকটা তাহার কাটতে গিয়েছি;
কচাৎ করে ভুলেই নিজের কানটা কেটেছি!
হল না, কিছুই হল না। অথচ চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি ভিন্সেন্ট নিষ্ঠায় তার কোন ফাঁকি ছিল না। জীবনে কী পেল সে? শুধুই উপেক্ষা, অবহেলা আর বিদ্রূপ! কিন্তু কেন? সে তো এমন প্রকাণ্ড কিছু দাবী করেনি! সে শুধু চেয়েছিল তার অন্তরের আকুতিকে রঙ আর রেখায় মূর্ত করতে। এই দুনিয়ার আলো বাতাস, গাছপালা, ফুল-ফল-পাখি তার ভাল লেগেছিল–দুনিয়াদারী করতে গিয়ে যে হতভাগা-দলের মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে তাদের জন্য ও দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চেয়েছিল; অমর্ত্যলোকের বার্তা পেয়ে যখন তার অন্তর অনির্বচনীয় আনন্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিল তখন সে সেই কথা জানাতে চেয়েছিল তার কাগজে আর ক্যানভাসে। তোমাদের তা ভাল লাগেনি। বেশ কথা। তোমরা তা তোমাদের ঘরে সাজিয়ে রেখ না। তার সৃষ্টি না হয় স্রষ্টার সঙ্গে মুছে যাবে। কিন্তু কেন উপেক্ষার সঙ্গে অপমান যোগ করছ? কেন প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে বিদ্রুপের কষাঘাত চাপিয়ে দিচ্ছ? কী ক্ষতি আমি করেছি তোমাদের?