ভিন্সেন্ট ভান গর্গের জীবদ্দশায় তার একখানি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু করুণাময় ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনায় সেকথা সে জেনে যেতে পারেনি।
এর দিন তিনেক পরে। কেবিনে একা শুয়ে আছে ভিন্সেন্ট, মনে হল কে একখানা হাত রাখল তার কপালে। নার্স এভাবে মাঝে মাঝে ওর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখত, তাই অভ্যস্ত স্পর্শে চোখ মেলে তাকায়। দেখে ওর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ডেভিডসন। অত্যন্ত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। অপরাধীর মত।
ভিন্সেন্ট স্লান হাসে। বলে, কবে ফিরলেন?
ঊর্মিলা ওর শয্যাপার্শ্বে বসে পড়ে। বলে, -ঘরে আর কেউ নেই ভিন্সেন্ট।
ভিন্সেন্ট চারদিক তাকিয়ে দেখে। বিকেল হয়ে এসেছে। খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত রোদ এসে কেবিনের মেঝেতে চতুষ্কোণ একটা আলোর আলপনা এঁকেছে। ঊর্মিলা মেমসাহেবের পোশাকেই সেজেছে; আজকাল সে শাড়ি পরে না বোধহয়। ভিন্সেন্ট তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ঊর্মিলার সেই চুলের গুচ্ছে অনেকখানি অংশ সাদা হয়ে গেছে। অস্তসূর্য-উদ্ভাসিত পশ্চিমাকাশে যেভাবে সোনালী মেঘের কোনায় কোনায় এসে লাগে প্লাটিনাম ব্লণ্ড সাদা মেঘের আস্তর। চোখের কোলেও বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে।
ভিন্সেন্ট বলে, দেখুন তো কাণ্ড! পাগলামি করলাম আমি, আর পালিয়ে বেড়ালেন আপনি!
মিসেস ডেভিডসন একটু ঝুঁকে পড়েন সামনের দিকে। ভিন্সেন্টের হাতখানা তুলে নিয়ে অস্ফুটে পুনরুক্তি করেন, তুমি আমার কথাটা শুনতে পাওনি, ঘরে আর কেউ নেই!
–শুনেছি। কিন্তু তাতে কি?
তাহলে এখনও আপনি-আপনি বলছ কেন ভিন্সেন্ট?
তবে কি বলে ডাকব? ঊর্মিলা?
না! পঁচিশ বছর আগেই তো একদিন আমার নামের লাটা কোন গাঙে ডুবে গিয়েছিল।
ভিন্সেন্ট হাসতে হাসতে বলে, কী বোকা ছিলাম আমি! তাই নয়!
ঊর্মিলা বলে, –এভাবে কেন শাস্তি দিলে নিজেকে? আমি ঠাট্টা করেছিলাম, সেটা বুঝলে না তুমি?
–ঈশপের গল্প পড়েছ ঊর্মি? তোমার কাছে যা ছিল ঠাট্টা আমার কাছে তাই সেদিন ছিল জীবনমরণের সমস্যা।
মাথাটা নিচু হয়ে গেল ঊর্মিলার। কোন জবাব যোগালো না মুখরা মেয়েটির মুখে। ভিন্সেন্টই পুনরায় বলে, তোমার দোষ দিচ্ছি না, ভুল বুঝো না আমাকে। তুমি স্বভাবতই চপল ছিলে। সব কিছুতেই ঠাট্টা-রসিকতায় উড়িয়ে দিতে। তাছাড়া তুমি বারে বারে আমাকে সাবধানও করেছ। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলে–আমি আকাশকুসুম। রচনা করছি। জেনেবুঝে আগুনে হাত দিয়েছিলাম আমি। আগুন তার স্বধর্ম অনুযায়ী কাজ করে গেছে। দোষ দেব কাকে? দোষ আমি কাউকে দিচ্ছি না।
নিজের ডান হাতের তালুটার দিকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে থাকে ভিন্সেন্ট।
-কী দেখছ হাতে?
হাতটা মেলে ধরে ঊর্মিলার সামনে। বলে, জীবনে দুটি নারীকে ভালবেসেছিলাম। তাদের প্রণয়চিহ্ন নিত্যসাথী হয়ে রইল আজীবন! আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলেই তোমাদের দুজনের কথা মনে পড়বে।
–সেও কি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল?
–হ্যাঁ। কারণ সে তখনই বুঝেছিল–আমি পাগল, বদ্ধ উন্মাদ।
–তখনই কি তোমার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে?
না হলে স্বেচ্ছায় হাতটা এভাবে প্রদীপ-শিখার উপর কেউ ধরে রাখতে পারে?
ঊর্মিলা ধীরে ধীরে ওর হাতের তালুতে হাত বুলিয়ে দেয়।
–আর কোন নারী আসেনি তোমার জীবনে? বিবাহ হয়নি?
–এসেছিল। বাতাসী। সাঁওতাল মেয়ে। দু বছর ঘর করেছি তার সঙ্গে। কিন্তু যে অর্থে তোমাদের দুজনকে ভালবেসেছিলাম সে অর্থে তাকে ভালবাসিনি।
আমরা দুজনেই তাহলে ব্যর্থ করে দিয়েছি তোমার জীবন! আজ এ অবস্থায় আমার ক্ষমা চাওয়াটা প্রহসনের মত শোনাবে! না ভিন্সেন্ট?
হঠাৎ উঠে বসে উত্তেজিত শিল্পী। ঊর্মিলার হাতখানা জোরে চেপে ধরে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, -কে বলেছে, আমার জীবন ব্যর্থ! করুণা করতে এসেছ ঊর্মিলা? দুটো মিঠে কথা বলে সান্ত্বনা দিতে এসেছ আমাকে? শুনে যাও–তোমাদের হাসি, তোমাদের ব্যঙ্গ, তোমাদের বিদ্রূপ আমাকে স্পর্শ করেনি! আমি যা দেখেছি, যা যা বুঝেছি, রঙে আর রেখায় তা বন্দী করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেলাম! আমার সে সৃষ্টির মূল্য একদিন কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করতে হবে পৃথিবীকে! আমার জীবন ব্যর্থ নয়!
ডক্টর ডেভিডসনের স্ত্রীর হাতটা আলগা হয়ে যায়। এ যে এখনও বদ্ধউন্মাদ!
ভিন্সেন্ট ওর আতঙ্ক-তাড়িত দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে ঊর্মিলা কি ভাবছে। কিন্তু থামতে পারে না। সে পুনরায় বলে, -মিসেস ডেভিডসন! একটা কথা মনে রাখবেন। আজ থেকে একশো বছর পরে যদি আপনার নাম কেউ উচ্চারণ করে তবে তা করবে এজন্য নয় যে, আপনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন, এজন্য নয় যে, আপনার বাড়ি-গাড়ি সম্পত্তি ছিল, এজন্য নয় যে, আপনি প্রখ্যাত ডাক্তারের সহধর্মিণী ছিলেন, তারা আপনার নাম স্মরণ করবে, কারণ আপনি ছিলেন শিল্পী ভিন্সেন্ট ভান গর্গের প্রথম প্রেম!
ভিন্সেন্টের মুঠি আলগা হয়ে যায়। আবার শুয়ে পড়ে সে। চোখ দুটো বুজে যায় তার। মিসেস ডেভিডসন ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় ঐ বদ্ধউন্মাদের কেবিন থেকে।
মাসখানেক সে ছিল ঐ উন্মাদাশ্রমে। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে এসে উঠল আমার বন্ধুর বাড়িতে। সূরযের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও সে দিল্লীতে গেল না। সূরযও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে আসল সমস্যা কোথায়! সত্যিই দাদাকে এনে সে কোথায় রাখবে? তাছাড়া সাময়িক উত্তেজনায় সে যে-কোন মুহূর্তে একটা বিশ্রী কাণ্ড করে বসতে পারে। মাসখানেকের মধ্যেই যে সুরযের বিবাহ হয়েছিল এ সংবাদ আমি কলকাতায় বসে পেলাম। সূরয নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিল আমাকে।