–ডাক্তার সাহেব অনুমতি দিয়েছেন। আমি ছবি আঁকি বসে বসে।
-কই, কি আঁকছিস দেখি!
ভিন্সেন্ট একখানা ক্যানভাস এনে আমাকে দেখালো। ইতিমধ্যে ওর ঘরে আবার আসবাবপত্র এসেছে। ওর কেবিনটা দ্বিতলে। পিছন দিকে একটা বড় জানালা। ভিন্সেন্ট ঐ জানালার ধারে গিয়ে বসে। ভিতরের উঠোনটার একটা ছবি এঁকেছে। অদ্ভুত ছবিখানা! মানসিক রোগাক্রান্তদের কিছু শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন। অথচ ওদের সাহস করে বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না। ফলে পাঁচিল-ঘেরা বন্দীশালায় ওরা গোল হয়ে পায়চারি করে। গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। সকলের একই রকম পোশাক, একই রকম ভঙ্গি। যেন ঝরাফুলের একটা গোল মালা। তালে তালে পা ফেলে ওরা ক্রমাগত পাক খায়। অনেকগুলি ফিগার এঁকেছে ভিন্সেন্ট। ডানদিকের এক কোণে উন্মাদাগারের তিনজন রক্ষী।
এ ছবিখানা ভিন্সেন্ট ডক্টর ডেভিডসনকে উপহার দিয়েছিল।
১৫-১৭. মাসখানেক হাসপাতালে
মাসখানেক ভিন্সেন্টকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। ওখান থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে মিসেস ঊর্মিলা ডেভিডসনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। বোধকরি না হলেই ভাল হত। মিসেস ডেভিডসন যে ফিরে এসেছেন তা ওর জানা ছিল না। সঙ্কোচে প্রশ্নটা সে কাউকে করতে পারেনি, ডক্টর ডেভিডসনকে তো নয়ই।
একদিন নার্স এসে জানালো ভিন্সেন্টকে বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে অদূরে, ডক্টর ডেভিডসনের কোয়ার্টার্স। সাহেব সেখানেই ছিলেন। বাগানটা পার হয়ে ওঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছতেই ডাক্তার সাহেব ওকে আহ্বান করেন, আসুন, আসুন মিস্টার ভান গর্গ। আপনার জন্য একটি সুসংবাদ আছে।
ভিন্সেন্ট মুখ তুলে দেখতে পায় ডাকপিয়ন রঘু দাঁড়িয়ে আছে। বলে, আপকো এক মনি-অর্ডার আসেছে। চালিশ রূপেয়া।
মাসের মাঝখানে এমন মনি-অর্ডার পেতে অভ্যস্ত নয় ভিন্সেন্ট। কুপনটা পড়ে দেখে দিল্লী থেকে সূরয টাকাটা পাঠিয়েছে। মনি-অর্ডার কুপনে লিখেছে, তোমার একটি ছবি বিক্রি হয়েছে। চল্লিশ টাকায়। টাকাটা পাঠালাম।
অদ্ভুত একটা আনন্দ পেল ভিন্সেন্ট। এই তার জীবনের প্রথম সাফল্য। দশ-পনের বছর ধরে সে একটি ফুলগাছের পরিচর্চা করে চলেছে। জল দিয়েছে, গোড়া খুঁড়ে দিয়েছে, সার দিয়েছে আর দিনের পর দিন লক্ষ্য করেছে ফুলগাছে কুঁড়ি এল কিনা! আজ তার সেই চারা গাছে প্রথম ফুল ফুটল। এর পর শুরু হবে তার জয়যাত্রা। স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে ভিন্সেন্ট।
রঘুর কাছ থেকে টাকাটা হাত পেতে নিয়ে প্রথমেই তাকে এক টাকা বসশিশ দেয়। তারপর ডাক্তার সাহেবের দিকে একখানা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে বলে, মিষ্টি আনতে দিন, সবাই খাবে!
একেবারে দশ টাকা? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন ডক্টর ডেভিডসন।
–পুরো টাকাটাই দিতাম। কিন্তু বাকি টাকায় কিছু রঙ আর ক্যানভাস কিনতে হবে। বলেন কি ডাক্তার সাহেব? আজ আমার কতবড় আনন্দের দিন জানেন! আজ প্রথম আমার ছবি বিক্রি হল!
এর আগে কখনও হয়নি বুঝি?
না, এই প্রথম।
প্রায় নাচতে নাচতে ভিন্সেন্ট ফিরে আসে তার কেবিনে। সামনে যাকে পায় খবরটা জানায়। কোবাল্ট ব্লু, সিপিয়া, আর ক্রোম ইয়ালোর টিউবগুলো ফুরিয়েছে। ওগুলো আনাতে হবে। আর কিছু ক্যানভাস। প্রথমেই ধরবে একটা সেলফ-পোর্ট্রেট। আচ্ছা, কোন্ ছবিখানা বিক্রি হল? সূরযের কাছে দশ-পনেরখানা ছবি আছে। তার ভিতর কোনখানা? সূরযটা চিরকালই একটা ক্যাবলা। আসল কথাটাই জানাতে ভুলেছে। কোষ্টা বিক্রি হল, কে কিনল তা তো লিখবি! অজ্ঞাত আর্টিস্টের একখানা ছবি নগদ চল্লিশ টাকায় হুট করে কেউ কেনে না। লোকটার নিশ্চয়ই সেটা বিশেষ কারণে ভাল লেগেছে। কী বলেছিল সে? ক্রেতার নামটা পর্যন্ত বলেনি। দিল্লীর কোন ছবির দোকানে সে কি ভিন্সেন্টের ছবিগুলো বিক্রয়াৰ্থে দিয়েছে? তখনই একটি চিঠি লিখতে বসল ভিন্সেন্ট। ব্যাপারটা জানতে হবে।
কুপনের লেখাটা পুনর্বার দেখবার জন্য সে পকেটে হাত দেয়। তারপর মনে পড়ে সে শুধু টাকাটাই নিয়ে এসেছে-কুপনটা পড়ে আছে ডাক্তার সাহেবের টেবিলে। তখনই উঠে পড়ে। আবার ফিরে যায় ডাক্তার সাহেবের খাস কামরায়। কুপনটা ফিরিয়ে আনতে।
ওঁর দ্বারের সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কথোপকথন কানে আসে। ঊর্মিলা বলছিল, সত্যি সত্যি ওর ছবি কেউ নগদ চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনেছে? আমি তো দেখছি ওর অনেক ছবি
বাধা দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন, –ক্ষেপেছ? এটা বোধহয় ওর ভাইয়ের একটা কারসাজি। দাদার জন্যই সেই তো সব খরচপত্র করছে। এভাবে একটা চল্লিশ টাকার মনি-অর্ডার করে দাদাকে সান্ত্বনা দিতে চায়। সত্যি সত্যি বিক্রি হলে সে নিশ্চয় সব কথা লিখত। কোন্ ছবিটা বিক্রি হল, কে কিনল
–সে-সব কথা বলেনি?
—অনর্গল কত আর মিথ্যে কথা লিখবে বল?
একটা তীক্ষ্ণ ছুঁচ কে যেন আমূল বিদ্ধ করে দিয়েছে ভান গর্গের মাথায়। ছি ছি ছি! এমন সহজ সরল কথাটা সে বুঝতে পারেনি! সত্যি সত্যি ছবি বিক্রি হলে সূরয লম্বা। চিঠি লিখত না? দাদার মত সেও তো আজ পনের বছর ধরে এই দিনটির প্রতীক্ষা করে আছে। একটা নিদারুণ হাহাকারে ওর মনটা ভরে গেল। চোখ ফেটে জল বার হয়ে আসে। কী মূর্খ সে! ও থেকে আবার দশ টাকা সে সকলকে মিষ্টি খেতে দিল।
লজ্জা! কী অপরিসীম লজ্জা! কেবিনে ফিরে এসে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।