ডাক্তার সাহেব পুনরায় বললেন, –সেদিন আমার স্ত্রী আপনার কান নিয়ে ঠাট্টা করেছিল বলে?
না না না! আপনার স্ত্রীর কোন দোষ নেই। আমি জানি না, কেন অমন কাণ্ডটা হঠাৎ করে বসলাম। তিনি কোথায়? তাঁর কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে।
–সে ঘটনার পরদিনই চলে গেছে। ওর মনে হয়েছে সেদিন বড় চড়া সুরে ঐ রসিকতা করেছিল সে। দিনকতকের জন্যে সে ঘুরে আসতে গেছে।
–ও! না, তার দোষ নেই! এ নিছকই একটা পাগলামি!
ডক্টর ডেভিডসনের কাছে ভিন্সেন্ট স্বীকার করতে পারেনি। করেছিল আমার কাছে। আমি দিনসাতেক পরে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন ও অনেকটা সুস্থ। হাসপাতাল থেকে তখনও ছাড়া পায়নি। আমার কাছে একেবারে ভেঙে পড়ল চন্দ্রভান। বললে, আমি এখন কি করব দীপু? আমি নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছি!
দূর, পাগল হলে এমন স্বাভাবিকভাবে কেউ কথা বলতে পারে?
–কিন্তু প্রতি তিনমাস অন্তর একটা বিশেষ তিথিতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, এটা তো ঠিক!
ভিন্সেন্ট হিসাব কষে দেখেছে ওর মানসিক বিকলতা একটা ছন্দ মেনে আসছে। গত চার-পাঁচ বারের আক্রমণের মাঝখানে প্রতিবারেই তিন মাসের ব্যবধান। পঁচাশি থেকে পঁচানব্বই দিনের একটা কালের ব্যাপ্তি। প্রতিবারেই পূর্ণিমার কাছাকাছি তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। সবটা শুনে আমি বলি, তাই যদি হবে এবার আমরা আগে থেকেই সাবধান হতে পারব। শুনলাম, এবার তুই দিল্লীতে সূরযের কাছে থাকবি?
মুখটা ম্লান হয়ে যায় ভিন্সেন্টের। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। বলে, প্রথমে তাই ভেবেছিলাম রে; কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে আমার। সূরয বিয়ে করতে যাচ্ছে। পাশের বাড়ি ওর শ্বশুরবাড়ি। ওরা কনৌজী ব্রাহ্মণ। আমাদের বাংলা দেশের মত নয়–ওরা নিশ্চয় খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ। আমি খ্রীষ্টান, কেমন করে থাকব সেখানে? তাছাড়া তিন মাস পরে পাগলামোর সময় যদি সূরযের বউকে-না না না, দীপু! সে কিছুতেই হতে পারে না!
তাহলে কী করতে চাস তুই?
–আমি এখানেই থাকব। গরম কমে এসেছে। এখন চেঞ্জাররা আসবে। তোর সেই ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক কি এবার শীতকালে রাঁচি আসবেন?
-না, এবার ওঁরা দক্ষিণ-ভারতে তীর্থে যাচ্ছেন। তুই যতদিন ইচ্ছে ওবাড়িতে থাকতে পারিস।
আহ, বাঁচালি!
বুকের থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল যেন ওর। নিরাশ্রয় আর্টিস্ট ভান গর্গের। বেচারির একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল ছোট ভাইয়ের ডেরা সেখানে যেতে ও ভরসা পায় না। তাই হাসপাজল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এটাই ছিল চিন্তা। আমি প্রশ্ন করি, হারে চন্দর, তুই গগ্যাকে সত্যিই খুন করতে গিয়েছিলি?
ও অনেকক্ষণ কোন জবাব দিল না। বোধকরি নিজের মনকেই ও প্রশ্নটা করল, আর তার জবাবের অপেক্ষায় চুপ করে বসে রইল। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, -হ্যাঁ!
–তুই কি সুযোগ পেলে এখনও গগ্যাকে খুন করতে চাস?
দূর! আমি তো এখন ভাল হয়ে গেছি! ও সময়…কেমন যেন…হঠাৎ…
কিভাবে কথাটা শেষ করবে বুঝে উঠতে পারে না। আমি পুনরায় বলি, তা যেন হল। গগ্যার ওপর তোর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। কিন্তু কানটা কি দোষ করল? হঠাৎ নিজের কানটা কেটে ফেললি কেন?
এবারও জবাব দিতে ওর দেরি হল। তারপর বললে, -ডক্টর ডেভিডসনকে বলিনি। কিন্তু তোকে বলব। লজ্জা পাওয়ার কথা আমার নয়, ওর। তাই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে…
ওর কথার মধ্যে বেশ অসঙ্গতি। জিজ্ঞাসা করি, কার কথা বলছিস তুই?
ঊর্মিলার! ঊর্মিলার শারদাঁ!
ভিন্সেন্ট কি এখনও স্বাভাবিক হয়নি? এ তো রীতিমত প্রলাপ! আমার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে তার সময় লাগে না। বলে, –আমি পাগলামি করছি না দীপু। ডক্টর ডেভিডসন বিয়ে করেছেন ফাদার শারদাঁর ভাইঝিকে। বিশ্বাস না হয় তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস।
সমস্ত কথাই খুলে বলেছিল ভিন্সেন্ট। কেন সে খুন করতে গিয়েছিল গগ্যাকে। বটুকেশ্বরের বউকে শুধু নয়, ভিন্সেন্টের মানসী প্রতিমাকেও ধূলায় টেনে নামিয়েছিল গগ্যা। তারপর বললে কেন হঠাৎ নিজের কানটা কেটে ফেলল। মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল ঠিকই কিন্তু কার্যকারণসম্পর্ক একটা আছে ওর পাগলামির। সমস্তটা শুনে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সব কথা ডক্টর ডেভিডসনকে খুলে বলা কি উচিত হবে? মিসেস ডেভিডসন নিঃসন্দেহে হৃদয়হীনতার প্রমাণ দিয়েছেন। ভিন্সেন্ট কেন যে তাঁকে চিনতে পারেনি, একথা তাঁর বোঝা উচিত ছিল। তা তো তিনি তলিয়ে দেখলেনই না, উপরন্তু ওর আহত স্থানে পুনরায় আঘাত করলেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভিন্সেন্ট সেই উপেক্ষার, সেই অবমাননার একটা চরম প্রতিশোধ নিয়ে বসল। নিজের কান কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ! নিরতিশয় আত্মগ্লানিতে মিসেস ডেভিডসন স্থানত্যাগ করেছেন নিজের কাছ থেকেই পালাতে চেয়েছেন তিনি। এসব কিছুই জানেন না তার স্বামী। এ ব্যাপারে যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেই ভিন্সেন্ট তার আত্ম-লাঞ্ছনার ইতিকথা গোপন করে গেছে ডাক্তার সাহেবের কাছে। ফলে আমি কেন তা প্রকাশ করে দিই? ডক্টর ডেভিডসনের কাছে তাঁর স্ত্রীকে অপদস্থ করি? অথচ সব কথা না জানলে ডাক্তার সাহেব ওর চিকিৎসাই বা করবেন কেমন করে?
মোট কথা অপ্রিয় সত্যটা আমাকে গোপন করেই যেতে হল। প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য । ওকে জিজ্ঞাসা করি, এখানে সারাদিন কি করিস? সময় কাটে কি করে?