কৃষ্ণকুমার, বিপিনচন্দ্র, ব্রহ্মবান্ধব প্রভৃতি এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। কিন্তু অভ্যর্থনা-সমিতির নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তকে তারা অগ্রাহ্যও করতে পারলেন না। ব্রহ্মবান্ধব বললেন, এ সিদ্ধান্ত আমরা যে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারিনি তার একটা নীরব প্রতিবাদ রাখতে চাই রজনীবাবু। আমরা কজন অভ্যর্থনা সমিতির নির্ধারিত আবাসে উঠব না। আপনার কলেজে একটু স্থান হবে?
রজনীকান্ত হাত দুটি জোড় করে বলেন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মশায়ের স্থান হবে না এমন বাড়ি শুধু বরিশাল কেন গোটা বাঙলা দেশে নেই। আমার কলেজ ধন্য হয়ে যাবে আপনাদের পদধূলি পড়লে।
তৎক্ষণাৎ তিনি ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবকদের ডেকে ব্যবস্থা করতে বললেন। বটুকেশ্বরের দল তো হাতে স্বর্গ পেল। অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির সভ্যদের সসম্মানে নিয়ে গিয়ে তুলল ওদের কলেজে।
অল্প পরেই ওঁরা এলেন, বলেন–এ কী! সম্মেলন শুরু হবার আগেই শিবির দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে?
কৃষ্ণকুমার বলেন–বন্দেমাতরম ধ্বনি যদি আপনারা ত্যাগ করতে মনস্থ করে থাকেন, তবে ঐ সঙ্গে আমাদেরও ত্যাগ করতে হবে।
তা তো হতে পারে না। ফলে রফা হল–পরদিন সকাল সাতটায় দুই শিবির থেকে সকলে এসে সমবেত হবেন রাজাবাহাদুরের হাবেলীতে। সেখানে সর্বপ্রথমে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিয়ে তারপর শোভাযাত্রা করে সভামণ্ডপে যাওয়া হবে।
সে রাত্রে সে কী উন্মাদনা! সারা শহরটা সে রাত্রে ঘুমায় নি। প্রভাত হলেই রাজাবাহাদুরের হাবেলীতে বরিশালবাসী বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দেবে। দেবে কার সঙ্গে? সুরেন বাঁড়ুজ্জে, রবীন্দ্রনাথ, বিপিন পাল, ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে। কিন্তু নাটকের সে তো শেষ নয়, সেই যে শুরু। জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সন আর পুলিস সুপার কেম্পকে না চেনে কে? বরিশালের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলতে এই দুই ইংরাজ শাসকও সে রাত্রে রুদ্ধ আক্রোশে ফুঁসছিল–তা কি জানতে বাকি আছে কারও?
চোদ্দই এপ্রিল, ১৯০৬। কোম্পানির বাগানে ধ্রুবানন্দের কাছে ধর্ণা দেওয়ার ঠিক এক বছর পরের দিনটি। সূর্যোদয়ের আগেই হাবেলী ময়দানে এসে হাজির হয়েছে বটুকেশ্বর। তার হাতে বন্দেমাতরম্ লেখা একগোছা ব্যাজ। এগুলি হাতে বাঁধবে অ্যান্টি-সাকুলার সমিতির সভ্যবৃন্দ। মাঠে এসে দেখে তার আগেও এসেছে অনেকে। পতাকা দণ্ডটা খাটানো হয়ে গেছে। মাননীয় অতিথিরা তখনও কেউ আসেন নি।
–এই তো বটুকদা! কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
–একি সুশীল! তুই কোত্থেকে?
কাল রাতের স্টিমারে এসেছি। কত খুঁজেছি আপনাকে। একবার ব্রজমোহন কলেজে, একবার স্টিমার ঘাটে।
রাত্রে কোথায় ছিলি?
–কলেজেই।
সুশীল সেন কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছে। এতবড় সম্মেলনটা দেখবার লোভ সামলাতে পারে নি। বটুক ওকে ডেকে নেয়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, বলে–এ হলো শ্রীসুশীলকুমার সেন। কলকাতার আর্যমিশনে পড়ে।
সুশীল খুব মিশুকে ছেলে। বরিশালের ছেলেদের ভাষাটা একটু অন্যরকম। ও কিন্তু হাসি চেপে থাকে। কলকাতায় ওদের বাঙাল বলে খেপানো চলে। এখানে ওকথা বললে ঠেঙিয়ে মুখের জিওগ্রাফি পালটে দেবে।
বটুক বলে–হ্যাঁরে, ওদের সব খবর কি? দ্বৈপায়ন, সূরয, গগনরা কেমন আছে?
-সূরয তো আমার সেক্শানেই পড়ছে, গগ্যাদা পড়াশুনা ছেড়ে দেশে চলে গেছে। দীপুদা প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে।
–আর চন্দ্রভান?
–সে বিবাগী হয়ে গেছে।
বিবাগী হয়ে গেছে! মানে? বাজে কথা?
না বটুকদা, সত্যিই। সে অনেক কাণ্ড
কিন্তু অনেক কাণ্ড শুনবার সময় নেই তখন বটুকেশ্বরের। ভলান্টিয়ারদের ফল-ইন করা নির্দেশ এসে গেছে। পিক পিক করে বাঁশি বাজছে। বটুক ছুটে গিয়ে সামিল হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে।
একটু পরেই এসে পড়লেন দেশবরেণ্য নেতারা। দু-দলেরই। এখন আর অবশ্য দু দল নন। সবাই এক দলের। এখানে কোন বক্তৃতা হবে না, কোন ভাষণ হবে না। আগে থেকেই তাই স্থির হয়ে আছে। শুধু বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দিয়ে ওঁরা শোভাযাত্রা করে এগিয়ে যাবেন সভামণ্ডপে। এতক্ষণে সূরয উঠেছে। কাতারে কাতারে মানুষ জমায়েত হয়েছে রাজাবাহাদুরের হাবেলীতে। শুধু মানুষই নয়, অমানুষও। লাল-পাগড়ি মাথায় অসংখ্য দেশীয় পুলিস, গুর্খা আর বালুচি রেজিমেন্টের বন্দুকধারী, আর লালমুখো অশ্বারোহী সার্জেন্ট।
কিন্তু পুলিস আর গোরার আবির্ভাবের কথা কি আর ওরা জানতো না? সব জেনে বুঝেই তো এসেছে ওরা। তাই আকাশ বিদীর্ণ করে সহস্র কণ্ঠে ওরা মাতৃবন্দনা ধ্বনি করল-বন্দেমাতরম্।
বার বার তিনবার। না, পুলিস লাঠি নিয়ে তেড়ে এল না। আইন-অমান্য করা হল আনুষ্ঠানিকভাবে। তবু তেড়ে এল না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমার্সন শহরে প্রাদেশিক সম্মেলন করার অনুমতি দিয়েছিলেন একটি মাত্র শর্তে–প্রকাশ্য স্থানে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি দেওয়া হবে না। প্রকাশ্য স্থানেই সে শর্ত ভেঙে ফেলা হল।
রওনা হল শোভাযাত্রা। প্রথম গাড়িতেই চলেছেন মূল সভাপতি ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল সাহেব। তার পাশে বসেছেন তার ইউরোপীয় স্ত্রী। বাদবাকি সবাই পদব্রজে। সভাপতিকেই শুধু গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। অভ্যর্থনা সমিতির তরফ থেকে অন্যান্য দেশবরেণ্য নেতাদের জন্যও গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল; কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ রাজী হন নি। বলেছিলেন, আমরা সেবক, আমরা নেতা নই। পায়ে হেঁটেই যাব আমরা।