- বইয়ের নামঃ আবার যদি ইচ্ছা কর
- লেখকের নামঃ নারায়ণ সান্যাল
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-২. অষ্টাদশ-পর্ব মহাভারত
অষ্টাদশ-পর্ব মহাভারত স্বহস্তে লিখেও বেচারি গণেশ মহাভারতকার হতে পারেননি। সে হিসাবে এ গ্রন্থের কাহিনীকার হিসাবে আমারও দাবী থাকা উচিত নয়। তবু একটু কিন্তু আছে। দেবাদিদেব গণপতি দ্রুতগতিতে শ্রুতি-লিখন লিখে গিয়েছিলেন মাত্র। আমি তা লিখিনি। নোট নিয়েছি–তারপর নিজের ভাষায় লিখেছি, কাট-ছাঁট করেছি, সাজিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি একমাত্র দ্বৈপায়ন-দাদুর মুখেই গোটা গল্পটা শুনিনি– কিছুটা পেয়েছি কীটদষ্ট পুরাতন দৈনিক ও মাসিক পত্রের পাতায়, কিছুটা বা পূর্বসুরীদের প্রকাশিত গ্রন্থে। তবু নিঃসংশয়ে স্বীকার করতে হবে, এ কাহিনী লেখার মূল প্রেরণাটা পেয়েছি দ্বৈপায়ন-দাদুর কাছে।
দ্বৈপায়ন-দাদু আমার মায়ের অতি দূর সম্পর্কের মামা। তবে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমার জন্মের আগে থেকেই। সম্পর্কটা মায়ের দিক থেকে হলেও বন্ধনটা দৃঢ়তর হয়েছিল বাবার সঙ্গেই। আমার বাবা ছিলেন শিবপুর কলেজের এঞ্জিনিয়ার, আর দ্বৈপায়ন-দাদু মেডিকেল কলেজের ডাক্তার। বয়সে বাবা কিছু বড় হতেন। অথচ দুই ভিন্নপথের বৈজ্ঞানিক কোথায় যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে ওঁদের বাড়িতে কতবার গিয়েছি। ওঁদের সেই বাগবাজারের সাবেকী বাড়িতে। বাবার সঙ্গে তাঁর কি সব আলোচনা হত। আমাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য দাদু আলমারি খুলে ছবির বই বার করে দিতেন। অপূর্ব সব রঙিন ছবির বই। আমি বিভোর হয়ে ছবি দেখতাম। ছবিগুলো আমার শিশুমনে গভীর রেখাপাত করেছিল সেই বয়সেই। তাই বাবা বাগবাজারে যাচ্ছেন শুনলেই আমি বায়না ধরতাম–তাঁর সঙ্গে যাব। মনে হয়, চিত্রশিল্পের দিকে ছেলেবেলা থেকে আমার যে ঝোঁকটা হয় তার জন্য দ্বৈপায়ন-দাদু অনেকাংশে দায়ী। তারপর আর তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না। আমার বাবা গত হয়েছে আজ প্রায় ত্রিশ বছর। এর মধ্যে দাদুকে আর দেখিনি। আসলে আমার বাবাই ছিলেন যোগসূত্র। তিনি গত হওয়ার পর দ্বৈপায়ন দাদুর সঙ্গে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা শিথিল হয়ে আসে। সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’ তরফেই নিমন্ত্রণ হয়–মা থাকতে বিজয়ার একখানা করে পোস্টকার্ড ছাড়তেন মনে আছে। তারপর যেমন হয়ে থাকে-ফারাকটা বেড়েই গেছে। তার চেহারাটা আবছা মনে পড়ে। ত্রিশ বছর আগে তাকে শেষবার যখন দেখি তখনই তিনি পঞ্চাশোর্ধ। টকটকে ফর্সা রঙ, কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত একমাথা চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর বাঙলার বাঘের মত একজোড়া পুরুষ্ট গোঁফ। পেশায় ডাক্তার হলে কি হয়, তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল–ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য ও ললিতকলায়।
লেখাপড়া শেষ করে চাকরি-বাকরি করি–বড় হয়ে অনেকবার মনে হয়েছে একবার তাঁর কাছে যাই। গিয়ে দেখি, সেই আশ্চর্য বইগুলো এখনও টিকে আছে কিনা তার আলমারিতে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। দ্বৈপায়ন-দাদু যে এখনও বেঁচে আছেন এ খবরটা জানতাম। শুনেছি এখনও তিনি চলে ফিরে বেড়াতে পারেন। ছানি কাটাবার পর চোখেও আবার দেখতে পাচ্ছেন।
বছরখানেক আগেকার কথা। কী খেয়াল হল–আমার সদ্য প্রকাশিত একটি গ্রন্থের এক কপি তাঁকে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম। লিখলাম–আপনি হয়তো আমাকে ঠিক মনে করতে পারবেন না। খুব ছোটবেলায় আপনি আমাকে দেখেছেন। বাবার সঙ্গে আপনার ওখানে যখন যেতাম তখন আপনি আমাকে অনেক ছবির বই দেখতে দিতেন। তখন আমি নিতান্ত শিশু, কিন্তু তখনই আমার দৃষ্টি প্রথম ছবির জগতের দিকে যায়। এ বইটি সেই ছবির দেখার বিষয়েই। বইটি আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে ভাল লাগবে। বাবাকে তো আর দেখাতে পারলাম না।
দাদুর কাছ থেকে কোন প্রাপ্তিসংবাদ আসেনি। তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম সে কথা।
প্রায় মাস ছয়েক পরে ছোট্ট একটা পোস্টকার্ডে এল ততোধিক ছোট্ট একটি চিঠি। হস্তাক্ষরে বার্ধক্যের ছাপ। হরফগুলো কেঁপে কেঁপে গেছে। লিখেছেন, ছিয়াশী চলছে, তাই তোমার বইটি শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগলো। একবার এলে ও-বিষয়ে সাক্ষাতে আলোচনা হতে পারে। আসার সময় আর এক কপি ‘অপরূপা অজন্তা’ নিয়ে এস।
ভাল লেগেছে কি লাগেনি সেকথার ধার দিয়েও যাননি। উনি না যান, আমাকে যেতে হবে। ওঁর কাছে। একটু খটকা লাগল। দ্বিতীয় আর এক কপি বই নিয়ে উনি কী করবেন? যা হোক এক রবিবারের সকালে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেই সাবেক বাড়িতে আছেন এখনও। দোতলা বাড়ি। সংস্কারের অভাবে জীর্ণ। পলেস্তারা খসে গেছে এখানে-ওখানে। রেনওয়াটারপাইপ ফেটে গেছে। একটা অশ্বত্থের চারা মাথা চাড়া দিয়েছে কার্নিশে। একতলায় একটা ওষুধের দোকান। সে-আমলে এখানে বসেই উনি রুগী দেখতেন। এখন ডিসপেন্সারী। দোতলায় একটা অংশ ভাড়া-দেওয়া, অপর অংশে থাকেন দ্বৈপায়ন-দাদু আর তার মেয়ে-সীমামাসি। সীমামাসিই দরজা খুলে দিতে এসেছিল। পরিচয় দিতেই আমার হাতটা খপ করে ধরে বলে–ওমা, তুমিই সেই নরেন? এখন কত বড় হয়ে গেছ! পথেঘাটে দেখলে চিনতেই পারতুম না। বাবা! দেখ কে এসেছে।
সীমামাসিকে আমি আদৌ চিনতে পারিনি। কখনও ওঁকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বাবার সঙ্গে যখন আসতাম তখন আমি এইটথ কি নাইনথ ক্লাসে পড়ি। পকেট বোঝাই হয়ে থাকত লাট্টু অথবা মার্বেলে। কোন মাসিকে এ বাড়িতে দেখেছি কই মনে তো পড়ে না। দিদিমাকে মনে আছে। লালপাড় শাড়ি পরনে কাছে বসিয়ে খাওয়াতেন। বোধহয় তখন সীমামাসি শ্বশুরবাড়িতে থাকত। তখনও নিশ্চয় সে বিধবা হয়নি।