বিরিঞ্চি বললে, নিশ্চয়ই না। এ কোনও বদলোকের কাছ। ভালো কথা, আপনাদের স্টেশনের পয়েন্টসম্যান গিরিধারীকে একবার ডাকুন তো!
–গিরিধারী!–গণেশবাবু সবিস্ময়ে বললেন, তাকে কেন?
বিরিঞ্চি কঠিন গলায় বললে, ডাকুন না। দরকার আছে।
কিন্তু স্টেশনে গিরিধারীকে পাওয়া গেল না। এদিক-ওদিক খুঁজে এসে রহমান বললে কোয়ার্টারে গেছে।
হাতের মুঠোর মধ্যে রিভলবারটা শক্ত করে ধরে বিরিঞ্চি বললেন, অনাদি, তুমি ঘর পাহারা দাও। আমি একবার গিরিধারীর সঙ্গে মোলাকাটা করে আসি।
অনাদি বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল, কোনও জবাব দিলে না।
তিনজনে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গিরিধারীর কোয়াটারের দিকে চলল। বিরিঞ্চি আগে আগে। প্রখর সূর্যের আলোয় জ্বলতে লাগল তার খাড়া চোয়াল আর আগুনের মতো চোখ। হাতের মুঠোর মধ্যে রিভলবারের ঈদোটা ক্রমেই গরম হয়ে উঠতে লাগল। আর গণেশবাবুর মনে। হতে লাগল, তাঁর চারপাশে একখানা অলক্ষ্য কালো হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে–যখন-তখন সে তার ভয়ঙ্কর থাবাটা ক্যাঁক করে তাঁর গলায় বসিয়ে দিতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ভেতর তখন থেকে ধড়াস ধড়াস করছে, আচমকা হার্টফেল করে বসবেন না তো গণেশবাবু?
একটা ছোট তামাকের খেত পেরিয়ে গিরিধারীর কোয়ার্টার। সামনে খুঁটোয় বাঁধা একটা গরু জাবনা চিবোচ্ছে। জনমানুষ কোথাও নেই।
–গিরিধারী, গিরিধারী!
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
অসহিষ্ণু হয়ে গণেশবাবু দরজায় ধাক্কা দিলেন : এই ব্যাটা, করছিস কী? মরে আছিস নাকি ঘরের ভেতরে?
গণেশবাবুর ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে দুফাঁক হয়ে গেল। আর পরক্ষণেই সকলের চোখে পড়ল
একটা দড়ির খাঁটিয়ার ওপরে একজন লোক পড়ে আছে। তার হাত-মুখ শক্ত করে কাপড় দিয়ে বাঁধা, চোখ দুটো অস্বাভাবিক বিস্ফারিত। আর তার বাঁধা মুখের ভেতর থেকে গোঁ-গোঁ করে একটা যন্ত্রণার চাপা শব্দ বেরিয়ে আসছে।
.
পাঁচ
গিরিধারী যা বললে তা অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার।
আপ আর ডাউন গাড়ি ক্রসিং হওয়ার পরে সে কোয়ার্টারে ফিরে আসে। ভারি খিদে পেয়েছিল তার। সকালে রান্না করে রেখে গিয়েছিল, ভেবেছিল ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে খাবারটা খেয়ে নেবে। কিন্তু দু-গ্রাস ভাত মুখে দিতেই তার কী যে হল সে জানে না। হঠাৎ মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল, তারপর সব অন্ধকার। যখন জ্ঞান হল সে দেখলে, এই খাঁটিয়াটার সঙ্গে কে তাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে গেছে। তার গায়ে যে কোম্পানির পোশাক ছিল, তাও উধাও।
–আমি পুলিশের লোক। আমার কাছে সত্য কথা বলবে। তা হলে বেলা বারোটার সময় তুমি প্ল্যাটফর্ম ঝাঁট দিচ্ছিলে না?
–না হুজুর।
–হঠাৎ একটা হাসির শব্দ তুমি শুনতে পাওনি?
–না হুজুর।
–হুঁ!–বিরিঞ্চি আর কথা বাড়াল না। গণেশবাবুকে বললে, চলুন–হয়েছে।
গণেশবাবু যেমন ভীত, তেমনি আকুল হয়ে উঠেছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী স্যার? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
–বোঝবার দরকার নেই–বিরিঞ্চি যেন তীব্রভাবে একটা ধমক দিলে : আপনি শুধু মুখ বুজে চুপ করে থাকুন। অনেক রহস্য আছে এর ভেতরে। যদি কোনও কথাবার্তা বলেন, তা হলে কিন্তু সব মাটি হয়ে যাবে বুঝেছেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ–শুকনো ঠোঁটটা চেটে গণেশবাবু জবাব দিলেন : আমি কোনও বিপদে পড়ব না তো?
–বলা যায় না। তবে, আপনি চুপ করে থাকলে সেটাই নিরাপদ হবে।
–অ্যা–বলা যায় না। গণেশবাবুর বুকের ভিতরটা ডাঙায় ভোলা মাছের মতো ধড়ফড় করে খাবি খেতে লাগল। মনের সামনে এখনও ভাসছে অন্ধকার রাত্রিটার ছবি, দরজার হাতলের ওপরে একখানা ভয়ঙ্কর কালো হাত। তারপর মড়ার মাথা, বিরিঞ্চির পিস্তলের শব্দ আর গিরিধারীর দুর্গতি সব মিলে কী-যে একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে, গণেশবাবু তা কল্পনাই করতে পারলেন না।
উঃ, হতভাগা গোমেজ। কী কুক্ষণেই ভাদুড়ীমশায়ের আমের ওপর তাঁর নজর পড়েছিল। এখন তার ঠ্যালা সামলাতে প্রাণ যায়। নাঃ–চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাবেন তিনি। প্রাণ আগে, না চাকরি আগে?
বিরিঞ্চির মাথার ভেতর তখন ধুধু করে আগুন জ্বলছে। সেও কিছু বুঝতে পারছে না। এ কী করে হল–এ কেমন করে সম্ভব। নিজের চোখে সে দেখেছে মেঝের উপর উবুড় হয়ে পড়ে আছে শ্ৰীমন্ত রায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। নিখুতভাবে ছোরার ঘা-টা যে তার বুকে লেগেছিল তাতেও সন্দেহ নেই। তবে?
তবে? বিরিঞ্চি মুঠোর মধ্যে শক্ত করে রিভলবারটা চেপে ধরল : তবে এ কী ব্যাপার? অনাদিকে আশ্বাস দিয়েছে বটে, কিন্তু ও-হাসি যে শ্ৰীমন্ত রায়ের, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। হ্যাঁ–নিঃসন্দেহে শ্ৰীমন্ত রায়। কিন্তু শ্ৰীমন্ত রায় কেমন করে আসবে এখানে? তা হলে এটা কি কোনও ভৌতিক ব্যাপার? একটা অশরীরী আত্মা?–গায়ের ভেতর শিরশির করে শিউরে গেল।
কিন্তু না–নিজেকেই একটা ধমক দিলে বিরিঞ্চি। ভূত-টুত ওসব নিতান্ত গাঁজাখুরি–ছেলে-ভোলানো ব্যাপার। ভূতে বিশ্বাস করে না বিরিঞ্চি। তাছাড়া এ তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, গিরিধারীকে খাঁটিয়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে একটা লোক গিরিধারী সেজে তাদের ওপর বেশ এক চাল চেলে গেল, এবং সে-লোক যে শ্ৰীমন্ত রায়, একথা বিরিঞ্চি কাগজে-কলমে লিখে দিতে পারে।
অতএব আর দেরি করা চলবে না। যা করবার আজকের রাত্রের মধ্যেই তা শেষ করে ফেলতে হবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, শিকার নিতাই সরকার। আর শিকারি দুজন–বিরিঞ্চি আর শ্ৰীমন্ত রায়। দেখা যাক–কে জেতে।