চার-পাঁচজন লোক তৎক্ষণাৎ তাঁর বাক্স আনতে ছুটল।
আর ঠিক সেই সময়—
ভিড় ঠেলে একটা মানুষ এসে দাঁড়াল। মেঘের মতো গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে!-কেয়া দেখা ডাক্তার সাব? জিন্দা হ্যায়-ইয়া মর গিয়া?
দুতিনশো লোকের চোখ এক সঙ্গে তার দিকে গিয়ে পড়ল। বিরাট চেহারা, দুটো আগুনের ভাঁটার মতো চোখ, বুনো বাঘের মতে ভয়ঙ্কর হিংষ তার মুখ। কাঁধে বন্দুক ঝুলছে। লোকটা এমন বীভৎস দেখতে যে তার দিকে তাকানো মাত্র প্রাণ কেঁপে ওঠে।
সমস্ত যাত্রী তবু আতঙ্কে তারই দিকে চেয়ে রইল। একটা কথা বলতে পারল না কেউ।
লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলে জিন্দা হ্যায় ডাক্তার সাব?
ডাক্তার বললে, এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু কিছু বলা যায় না। গাড়ি ব্যাক করিয়ে এখুনি। একে কোনও শহরে নিয়ে যেতে হবে; যেখানে হাসপাতাল আছে। অপারেশন করার পরে বোঝা যাবে সব।
–নাও বাঁচতে পারে?
ডাক্তার বললেন, বলেছি তো, কিছুই বলা যায় না।
সেই বিরাট জোয়ানটা লাইনের ওপর বসে পড়ল–যেন শিকারির গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল একটা পাগলা হাতি। তারপর ঝুঁকে পড়ল রঘুর ওপর। ভাঙা গলায় বলতে লাগল : রঘুয়া, রঘুয়া, মুঝে মাপ করে দে! তুই বেইমান নোস–বেইমান এই বৃন্দা সিং।
যে জান দেয়, রাজপুত কখনও তার জান নেয় না। রঘুয়া, মুঝে মাফ কর দে—
ডাক্তার কেবল সাহস করে কথা বলতে পারলেন–কে–কে তুমি?
–আমি ডাকাত বৃন্দা সিং, আমিই গাড়ি লুটতে চেয়েছিলাম। বৃন্দা সিংয়ের দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল : এই গাড়িতে কোনও পুলিশ নেই? আমাকে গিরেফতার করো–থানে মে লে যাও, আমার ফাঁসি হোক। জান দেনেওয়ালার জান যে নিতে পারে, ফাঁসিকাঠই তার আসল জায়গা।
ডাক্তারের ব্যাগ এসে পড়েছিল। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেও যেন ভুলে গেলেন তিনি।
.
রাঘবের জয়যাত্রা আমি এই পর্যন্ত লিখছি, এমন সময় ধড়াম করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। লম্বা-চওড়া হাসিমুখ সার্জেন্টটি এসে ঢুকল আমার ঘরে।
দাদা, কী লিখছেন?
আমি হেসে বললুম, তোমাদের কীর্তি কাহিনীই শোনাচ্ছিলাম রামধনুর হোট ছেলেমেয়েদের।
–বোসো রাঘব, বোসো।
হ্যাঁ, ঘরে ঢুকেছে রাঘবলাল সিং। সেই পেটুক ক্যাবলা ছেলেটি আর নেই। যেমন স্বাস্থ্য তেমনি বুদ্ধিতে ঝলমল করছে চোখ-মুখ।
ঘর কাঁপিয়ে হাহা করে হেসে উঠল রাঘব।
–আমার কীর্তি? তা বটে। জীবনে কী দিনগুলোই যে গেছে।
বললাম, সেই দুঃখের অভিজ্ঞতা না হলে তুমি তো মানুষ হতে পারতে না রাঘব। আর সেদিন নিজের প্রাণ দিয়েও তুমি ট্রেনটাকে বাঁচাতে পেরেছিলে বলেই তো ট্রেনের যাত্রী পুলিশ কমিশনারের চোখের ওপর পড়েছিলে। ভালো কথা, বৃন্দা সিংয়ের খবর কী?
–ভালই আছে বুড়ো। জেল থেকে বেরিয়ে জয়পুরের যে-ছোট দোকানটা করেছিল সেটা বড় হয়েছে এখন। আমাকে দেওয়ালির আশীর্বাদ করে পাঠিয়েছে।
–মুরলীর আর কোনও সন্ধান পাওনি?
রাঘবের মুখের ওপর ছায়া পড়ল। একবারের জন্য ছলছল করে উঠল চোখ।
–আজ পনেরো বছরের ভেতরেও তার কোনও খোঁজ পাইনি দাদা। সেই রাতে বলরামপুরের জঙ্গলে সে চিরদিনের মতো মুছে গেছে। হয়তো কিষণলালের সঙ্গে থেকে এখনও ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে, হয়তো কোথাও পুলিশের গুলি খেয়ে মরেছে, হয়তো বা সদরের মতো ভালো হয়ে ঘরে ফিরে গেছে–
রাঘবলাল বললে, জানি না দাদা।
মস্ত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। আমরা দুজনেই বিষগ্রভাবে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। সেই সময় ঘরে ঢুকলেন আমার কাকিমা। তাঁর হাতে প্রকাও একথালা মিষ্টি।
–রাঘবের গলার আওয়াজ পেয়ে বিজয়ার মিষ্টি নিয়ে এলুম।
রাঘব উঠে দাঁড়িয়ে কাকিমাকে প্রণাম করলে, তারপর আমাকেও।
–আরে, তাই তো ভুলে গিয়েছিলুম যে। কিন্তু কাকিমা, এ যে প্রায় সেরদেড়েক মিষ্টি! খেতে পারব?
কাকিমা বললে, এমন জোয়ান ছেলে—এ-কটা খেতে পারবে না কেন? খাওখাও।
–তোমার বাবার দোকান থেকেই এসেছে।
আমি হাসলুম : তুমি যদিও এখন আর নিজেদের মিষ্টি খাও না–তবু এই ছানার জিলিপিগুলো একবার পরখ করে দেখতে পারো। চমৎকার হয়েছে।
–ছানার জিলিপি! সেই মারাত্মক ছানার জিলিপি!
আবার অট্টহাসিতে ঘর কাঁপিয়ে তুলে রাঘবলাল খাবারের থালাটা কাছে টেনে নিলে।