জঙ্গল পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু-জনে যেখানে এল, সেখান থেকে স্টেশন প্রায় চার মাইল দূরে। এইখানটাই সবচেয়ে নিরিবিলি; এর ত্রিসীমানাতে জনমানুষেরও চিহ্ন নেই। তেওয়ারি বললে, ইধার বহুৎ শের (বাঘ) ভি হ্যায়। কিন্তু শেরাও ডাকুকে ভয় করে, তার কাছে এগোয় না।
দুপাশে ঘন বন, মাঝখান দিয়ে রেলের লাইন চকচক করেছ। চাঁদ নেই, কিন্তু আকাশ-ভরা তারার আলোয় আইন জ্বলছে, সাদা সাদা নুড়িগুলো পর্যন্ত ঝিকমিক করছে। তেওয়ারি বললে, হিয়াঁ–
তেওয়ারি বানিয়ে বলেনি। আধঘণ্টার মধ্যেই লাইন থেকে দুজনে গোটা-চারেক জোড় খুলে ফেলল, লোহার বলটুগুলোকে তেওয়ারি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে দিল বনের মধ্যে। বললে, উপরসে কুছ মালুম নেহি হোগা, লেকিন গাড়ি যব আয়েগা, তব–
কাজ শেষ করে দুজনে জঙ্গলের মধ্যে নেমে এল। খানিকটা যেতেই চোখেমুখে টর্চের আলো এসে পড়ল একরাশ।
বৃন্দা সিং দলবল নিয়ে হাজির।
–হো গিয়া?
–হে গিয়া সর্দার।
–ঠিক হ্যায়।–একবার হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল বৃন্দা সিং–আউর পর (পনের) মিনট। সব কোঁই এইি বৈঠ যাও।
সব ছায়ামূর্তির মতো বসে রইল সেখানে। ঝিঁঝির ডাক বেজে চলল, বনের পাতায়-পাতায় হাওয়া উঠল, দূরে যেন বাঘের ডাকও শোনা গেল একবার। কারও মুখে কোন কথা নেই। মুরলী শুধু একবার ফিসফিস করে ডাকল, রঘু। কিন্তু রঘুকে পাশে দেখতে পেল না, কোথায় যেন উঠে গেছে সে।
ঝম্ ঝম্ ঝম্! চাকার আর লোহার শব্দ–একটা গভীর বাঁশির আওয়াজ। মেল ট্রেন আসছেদূরের বাঁকটা ঘুরছে। আর তিন মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে জোড় খোলা লাইনের ওপর।
সর্দার বললে, সব তৈয়ার?
–তৈয়ার?
ট্রেন আসছে–আরও কাছে আসছে। কিন্তু এ কী। জোড়ের মুখে আসবার ঠিক আগেই জোরালো একটা বাঁশি বাজিয়ে বিকট আওয়াজে থেমে গেল কেন? এমন তো কথা ছিল না। বারোজোড়া চোখ জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল বাঘের মতো।
ও কে? টর্চের মুখে লাল কাপড় বেঁধে এখনও লাইনের ওপর দোলাচ্ছে কে? ওই তো গাড়িটাকে ঠিক জোড়ের মুখে থামিয়ে দিয়েছে। ট্রেনের সার্চলাইটের আলোয় তাকে চিনতে আর কারও বাকি নেই।
–বঘুয়া! বেইমান!–এক মুরলী ছাড়া এগারোটা গলা একসঙ্গে গর্জন করে উঠল।
বৃন্দা সিং বন্দুক তুলল। দাঁতে দাঁত ঘষে বললে, পহেলে উসকো খতম কর দেনা–
বন্দুক তুলল, কিন্তু ট্রিগার টানতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, মন্দিরে সেদিন সাপের হাতে নির্ঘাত মরণ থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল রঘু। যো জান দিয়া, উসকো জান লেনা? রামরাম। রাজপুত কখনও একাজ করতে পারে?
কিন্তু ট্রিগার টানল কিষণলাল। দুম করে শব্দ, নীল আগুনের ঝলক, তারপর একটা চাপা চিৎকার করে রঘু লাইনের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
.
বারো
ততক্ষণে একটা বিরাট হইহই শুরু হয়ে গেছে চারদিকে।
ড্রাইভার ফায়ারম্যান সব নেমেছে, গার্ড এগিয়ে এসেছেন। ট্রেনের ঘুমন্ত যাত্রীদের কাছেও পৌঁছে গেছে খবরটা। দেখতে-দেখতে তিন-চারশো লোক জড়ো হয়ে গেছে সেখানে।
–ক্যা হুয়া?
–হোয়া দি ম্যাটার?
–কী হয়েছে কী হয়েছে?
ইঞ্জিনের দিনকরা আলোতে কী যে হয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই কারও। মাত্র সাত-আট হাত আগেই লাইনের দুধারে নাট বল্ট আর ফিসপ্লেট ছড়ানো। ঠিক সময়মতো গাড়িটা থেমে না গেলে কী যে হত তা ধারণাও করা যায় না। মারাত্মক অ্যাসিডেন্ট হত–গাড়ি উল্টে পড়ত, কতগুলো মানুষের যে প্রাণ যেত কে বলতে পারে!
আর এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা থেকে ট্রেনটাকে যে বাঁচিয়েছে সে–
যেন লাইনের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে রঘু। লাল কাপড়ে জড়ানো টর্চটা ছিটকে চলে গেছে দূরে, মাথা থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে।
কে এ? কোথা থেকে এল? ট্রেনের ড্রাইভার বলল, গাড়িটা থেমে যাওয়ার মিনিট খানেক পরেই সে বন্দুকের মতো আওয়াজ শুনেছে একটা। মনে হয়, পাশের জঙ্গল থেকে ছেলেটাকে গুলি করেছে কেউ।
পাশের জঙ্গল–তা বটে! লাইনের দু ধারে ঘন কালো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে যেন অন্ধকারের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সেই জমাটি কালো বনের গায়ে হাজার হাজার জোনাকির আলো লাখ-লাখ ভূতের চোখের মতো জ্বলছে আর নিবছে। ট্রেন-থেমে-যাওয়া অদ্ভুত নিস্তব্ধতার ভেতরে তীব্র স্বরে ঝিঁঝির ডাক উঠছে-মনে হচ্ছে যেন হাজার করাত চালিয়ে আকাশটাকে কারা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে চাইছে।
কে একজন শুকনো গলায় বললে, এ বলরামপুরের জঙ্গল। বাঘ-ভালুক আছে–ভয়ানক জায়গা।
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলের ভেতর কোথা থেকে এল এই ছোট ছেলেটি–ট্রেনটাকে এমন সাংঘাতিক অপঘাত থেকে বাঁচিয়ে দিলে? আর বনের মধ্যে থেকে কেইবা তাকে গুলি করে বসল?
চারদিকে তাকিয়ে গাড়ির তিন-চারশো যাত্রীর বুক ছমছম করতে লাগল!
যাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন রাঘবের পাশে।
রঘু একবার নড়ল, একবার চাপা গলায় বললে, মা–তারপরেই আবার নিঃসাড় হয়ে গেল।
ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন। তখনও নিঃশ্বাস পড়ছে। কিন্তু–
বুকের ডান দিক থেকে রক্ত গড়িয়ে রেলের সিপার আর নুড়িগুলো রাঙা হয়ে গেছে। ডাক্তার রুমাল দিয়ে রক্ত মুছে ফেললেন। ঠিক কাঁধের নীচে বিঁধেছে গুলিটা। ডানদিক বলেই বেঁচে আছে এখনও। বাঁ দিক হলে সোজা হৃৎপিণ্ডে চলে যেত।
ডাক্তার দাঁড়িয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে আমার ডাক্তারি বাক্সটা কেউ নিয়ে আসুন শিগগির।–দেরি করবেন না—