–তোমাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের মা বাপ ভাই-বোন ছেলে-মেয়ে আছে, তারা কেমন করে মানুষ খুন করে ভাই মুরলী?
–বললুম তো হাত দুর হয়ে যায়। তখন মুরলী মারা আর মানুষ মারায় কোনও তফাত থাকে না।
–আর ধরা পড়লে?
–ফাঁসি কা তক্তা। গলায় দড়ি পরে ড্যাং ড্যাং করে দু-মিনিট বহুৎ মজাদার নাচ। ব্যস, উসকে বাদ খেল খতম।-মুরলী হি-হি করে হেসে উঠল আবার। আর রাঘবের মনে মুরলী কী অসহ্য নিষ্ঠুর–মন বলে, মায়া-মমতা বলে ওরও বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই আর।
আজকে রঘুর প্রথম রাত। তারও প্রথম হাতেখড়ি। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য টদিয়ে। একজন-দুজন নয় কয়েকশো নিশ্চিন্ত নিরীহ মানুষকে খুন করে। চমৎকার।
ভাবতে ভাবতে হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসে! তাই, ভেবে আর দরকার নেই। যা হওয়ার হবে।
রঘু আলোচনাটা ঘুরিয়ে নিলে।
–তোর ছেলেবেলার কথা কিছু মনে নেই মুরলী? বৃন্দা সিংয়ের কাছে আসবার আগেকার কোন কথা?
মুরলী যেন চমকে উঠল। তারপর চেয়ে রইল সামনের দিকে–যেখানে পলাশের মাথাগুলো লালে লাল, যেখানে সোনালি আলোয়লতার জালে কয়েকটা কুল গাছ ঢাকা পড়ে গেলেও একরাশ লাল-হলুদ পাকা ফল উঁকি মারছে তার ভেতর থেকে। একজোড়া ঘুঘু ওদের সামনেই উড়ে পড়ে মাটি থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল, ওদের বসে থাকতে দেখেও এতটুকু ভয় পেল না, পাখিদের সোনা নেই, টাকা-গয়না নেই–তাই ডাকাতদের তারা ভয়ও পায় না।
–আমার ছেলেবেলা? বচ্পন? মুরলী যেন ঘুমের মধ্যে থেকে জেগে উঠল : একটু-একটু মনে আসে ভাই। যেন স্বপ্নের মতো লাগে। একটা ভৈষাঁর পিঠে চড়ে বাবার সঙ্গে চলেছি। পথের ধারে জলের ভেতর পদ্মফুল ফুটেছেলতায় লতায় সিঙাড়া ধরেছে। দূরে মহাবীরজীর একটা লাল ঝাণ্ডা দেখা যায় বটগাছের মাথায়–সেখানে মেলা বসেছে–এতদূর থেকেও মানুষের গলার আওয়াজ শুনি। আমি যেন বাবাকে বলি, বাবা মেলায় গিয়ে আমাকে লাড়ু আর জিলাবি কিনে দিতে হবে।
–তারপর? রঘুর চোখ চকচক করে উঠল।
–আবার দেখি,–তেমনি ঘুমভাঙা গলায় বলে চলল মুরলী : কোথায় যেন রামলীলা হচ্ছে। ঢোলক বাজছে করতাল বাজছে সীতা মাইজী নেচে নেচে গান করছে, কোত্থেকে চলে এল দুশমন রাবোয়া। সীতাজীকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর বাবার কোলে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়লুম।
মুরলী দীর্ঘশ্বাস ফেলল : আর কিছু মনে নেই।
–আমার মা বাবার কাছে যাবি মুরলী?
মুরলী অদ্ভুত উদাস দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। জবাব দিল না।
–যাবি মুরলী?
মুরলী হয়তো এবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, আবার চকচক করে উঠেছিল তার চোখ দুটো। কিন্তু কোনও কথা বলবার সে সুযোগ পেল না। তার আগেই বন কাঁপিয়ে বাঘের ডাকের মতো গম্ভীর গলা ভেসে এল : মুরলী–মুরলী–
দুজনেই চমকে কান খাড়া করল। কে ডাকছে?
আবর লহরে লহরে ভেসে আসতে লাগল সেই ডাক : মুরলী–এ মুরলী? কিধার গিয়া রে তুম?
–সর্দার।
মুরলী লাফিয়ে উঠল। চল রঘুয়া, শিগগির চল। কী কাজে যেন ডাক পড়েছে।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল সে। সাড়া দিয়ে বললে, আতা হুঁ সর্দার, আভি ম্যায় আতা হুঁ—
রাঘব ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চলল পেছনে পেছনে। পা দুটো তার আর চলতে চায় না। মুরলীর কাছ থেকে কথাটার জবাব পাওয়া গেল না। আর পাওয়া গেলেই বা কী লাভ হত? আজকের এই দুঃস্বপ্নের রাতটার পরে রঘুই কি আর কখনও নিজের বাবা-মার কাছে ফিরে যেতে পারবে?
দিন কাটে–রোজ যেমন কাটে। এরই মধ্যে চলল আলাপ-আলোচনা, তলোয়ারে শান দেওয়া বন্দুক পরিষ্কার করা। চাপা উত্তেজনা থমথম করছে চারদিকে। ভুট্টারাম লাফিয়ে উঠছে থেকে থেকে, বহুৎ দিনোঁকে বাদ আজ এক ভারি কাম হোগা। কিন্তু সেই ভারি কাজটা যে কী, সে তা এখনও জানে না। ভুট্টারামের লাফানি দেখে এত দুঃখের মধ্যেও হাসি পাচ্ছে রাঘবের।
একবার কিষণলাল এসে জিজ্ঞেস করল, ভয় হচ্ছে নাকি রে রঘুয়া?
–নেহি গুরুজী।
কিষণলাল বললে, বহুৎ আচ্ছা। পহেলি দফে কলিজা সবারই একটু গড়বড়ায়, কিন্তু তোর দেখছি খুব শক্ত। বড়ে খুশিকা বাত।
দিন কাটল, সন্ধ্যা নামল, রাত হল। পোড়ো বাড়িটার ঘরে ঘরে মিটমিটে আলো জ্বলল। অন্য দিন নটা বাজতে-নাবাজতে জোয়ানের দল খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে, উঠে পড়ে রাত চারটের পরেই। কিন্তু আজ আর কারও চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। সবাই তৈরি হচ্ছে।
এগারোটা–বারোটা—
তখন তেওয়ারি এসে ডাকল :রঘুয়া চল—
মুরলী অবাক হয়ে বললে, ও কোথায় যাচ্ছে?
–কাম মে! তেওয়ারি হেসে বললে : আও রঘুয়া!
রঘু বেরিয়ে গেল তেওয়ারির সঙ্গে। অবাক হয়ে চেয়ে রইল মুরলী–ব্যাপারটা এখনও সে বুঝতে পারছে না।
দুজনে দুটো টর্চ নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে দিয়ে এগিয়ে চলল। আজও তেমনি লাখে লাখে জোনাকি জ্বলছে, চারদিকে সেই থরেথরে অন্ধকার–বনের গাছপালা কন্ধকাটার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু রঘু কিছু টের পাচ্ছিল না। ঝিঁঝির ডাক ছাপিয়ে তার কান ভরে বাজছিল নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ।
যেতে যেতে সব বুঝিয়ে বলল তেওয়ারি। রঘু শুনতে লাগল।
তেওয়ারির হাতে যে-থলেটি আছে তার মধ্যে রয়েছে হাতুড়ি, সাঁড়াশি, রেঞ্চ–এইসব। এইগুলো দিয়ে লাইনের তিন-চারটে জোড় সে খুলে দেবে। রঘু আলো ধরে তাকে সাহায্য করবে।
ব্যস, আধি ঘণ্টেকে কাম। এর মধ্যে সর্দার তার দলবল নিয়ে তৈরি হয়ে চলে আসবে। একটু পরেই আসবে ডাকগাড়ি। উসকে বাদ–ওর পরে কী যে হবে, সেটা আর তেওয়ারি বলল না। দু-তিনবার টেনে-টেনে হাসল, আর সেই হাসি শুনেই রঘুর রক্ত যেন জল হয়ে গেল।