–এ হি তো ঠিক বাত! মুরলী বললে, আমার অবশ্য গোড়াতে খুব ভয় করত। এখন ভালোই লাগে।
–না-হক মানুষ মারতে ভালো লাগে?
ফস করে রাঘ রাঘব জিজ্ঞেস করে বসল।
মুরলী কেমন থতমত খেয়ে গেল। বললে, না খুন-জখম নয় তবে অনেক রুপেয়া আউর জেবরাত (গয়না) মিলে–
–এই টাকা-গয়না দিয়ে কী হবে মুরলী? মুরলী একটু চুপ করে রইল। তরপর বললে, ইয়ে সওয়াল তো ঠিক হয়, লেকিন
–লেকিন?
মুরলী আবার চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। যেন কী জবাব দিবে খুঁজে পাচ্ছে বা।
রঘু বললে, এখন হাতে কোনও কাজ আছে মুরলী?
কুছ না, কুছ না। কাজকাম যো কুছ হেবে, সে তো রাতের-বেলা। এখন ছুট্টি।
–তা হলে চল, বেড়িয়ে আসি।
–কোথায় যাবি?
–বনের ভেতর।
–বনের ভেতর! যদি বাঘ আসে?
–কিছু হবে না। রঘু হাসল : ডাকুকে বাঘেও ভয় পায়।
মুরলীও হাসল : চল তা হলে।
দুজনে বেরিয়ে পড়ল। ভিজে-ভিজে কালো মাটির ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়ে-চলা পথ–বৃন্দা সিংয়ের দলের মতোই দুজন বেপরোয়া মানুষ চলাচল করে কেবল তা দিয়ে। সরকারি জঙ্গল হলে হয়তো সরকারের লোকজনের আসা-যাওয়া থাকত, গাছের গায়ে নম্বর পড়ত, একটা জঙ্গল-অফিসও থাকত হয়তো। কিন্তু এই বনের মালিক কোন্ রাজাবাহাদুর–অনেক আগে বড় বড় সাহেবদের নিয়ে শিকার খেলতে আসতেন–এখন সেসব বন্ধ হয়ে গেছে। জঙ্গল পড়ে আছে–খুশিমতো কাঠুরিয়ারা এসে বাইরে থেকে দুটো-চারটে গাছ কাটে, কিন্তু বাঘের ভয়ে কেউ সাহস করে ভেতরে ঢোকে না। তাই বৃন্দা সিংয়ের পক্ষে একটা চমৎকার আস্তানা বলরামপুরের জঙ্গল। রাজাদের কালীবাড়িতে এখন ডাকাতেরাই পুজো চড়ায়।
দুজনে চলতে লাগল। এখানে-ওখানে থোকায় থোকায় আমলকী যেন সবুজ ফটিকের গুচ্ছের মতো দুলছে। ভাঁট ফুল ফুটেছে হলদে-লাল আরও নানারকম অজানা ফুলে ছেয়ে গেছে ঝোঁপঝাড়, মাটির বুক থেকে এক-একটা নীল আলোর মতো জেগে উঠেছে ভূঁইচাপা। কয়েকটা পলাশ-শিমুল লালে লাল। বনে বসন্ত।
রঘুর মনে পড়ল, এই সময় সরস্বতী পুজো হয়ে যায়–স্কুলের প্রতিমাকে তারা পলাশ ফুল দিয়ে ঢেকে দিত; তারপর আসত দোল। সেই আবির-পিচকারিকুম নিয়ে সারাদিন কী আনন্দ। রঘুর মাথায় টুপি পরিয়ে, গায়ে রং আর কালিঝুলি মাখিয়ে ছেলেরা তাকে হোলির রাজা সাজাত–সবাই তাকে ঠাট্টা করত। কিন্তু এখন তার মনে হল, এদের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার দোলের রাজা সাজতে পারাও কত সুখের কত আনন্দের ব্যাপার।
মুরলী বললে, এই রঘুয়া–কী ভাবছিস?
–কিছু না।
–আয়, বসি কোথাও।
–বোস।
এক জায়গায় অনেকখানি জুড়ে প্রকাণ্ড একটা গাছ দাঁড়িয়ে। মোটা মোটা অসংখ্য শিকড় মাটি খুঁড়ে উঠেছে তার। গাছটায় ফিকে লাল রঙের ফুল ফুটেছে অজস্র; একটা মিঠে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বনে, হাওয়ায় বৃষ্টির গুঁড়োর মতো পাপড়ি ঝরছে। অসংখ্য খুদে মৌমাছির ভিড় জমেছে গাছটাতে। দুজনে তারই দুটো শিকড়ে পড়ল।
–আচ্ছা মুরলী?
–কী রে?
–আজ রাতে একটা ডাকাতি হবে কোথায়–না?
–তাই তো মনে হচ্ছে। মুরলীকে নির্বিকার মনে হল। এসবে এখন আর ওর কিছু বিশেষ আসে-যায় না, অনেকদিন ধরে দলের সঙ্গে থাকতে থাকতে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে এ-সমস্ত।
–মানুষ মরবে?
–মরতে পারে দু-চারজন। আবার যদি কিছু গোলমাল না করে সব দিয়ে দেয়, তা হলে কাউকে কিছু বলবে না সর্দার। এদিকে সর্দারের দিল খুব দরাজ।
–আচ্ছা, দলের লোক মরে না কখনও।
–মরে বই কি ধরাও পড়ে। কভি কভি গাঁয়ের লোকের সঙ্গে জবর লড়াই ভি হয়–তখন দুদলেই পাঁচ-সাতজন ঘায়েল হয়ে যায়। এই তো তিন-মাহিনা আগে-মুরলী অন্যমনস্ক হয়ে গেল : ছারা জিলার এক গাঁয়ের মহাজনবাড়ি আমরা লুটতে গেলাম। বাড়িতে বন্দুক ছিল, গাঁওবালা আদমি ভি এসে হাজির হল। জোর লড়াই বাধল তখন। এদের পাঁচ-সাতজন খতম হল, আমাদের তিন-তিন জোয়ান ভি। মুরলীর চোখে জল এল : জানিস রঘুয়া, ফাগুলাল ছিল আমারই বয়েসী, তোর চাইতেও আমার ভারি দোস্তি ছিল তার সঙ্গে। মহাজনের গুলিতে তার পায়ে এমন চোট লাগল যে এক-পা আর চলতে পারে না। তাকে আনাও যায় না-ফেলে আসাও যায় না। পুলিশের হাতে পড়লে সব হয়তো কবুল করে দেবে। তখন সর্দার কী করলে জানিস? তলোয়ারে এক কোপে একদম জিন্দা ফাগুলালের মাথাটা কেটে নিলে, তারপর সেই মুণ্ডুটা খানিকটা দুরে দরিয়ায়
–থাক, থাক, আর বলতে হবে না- রঘু কান চেপে ধরল।
–এখন শুনতে খারাপ লাগছে, কিন্তু তোরও অভ্যেস হয়ে যাবে। হয়তো আজ রাতেই দেখছি, আমি ঘায়েল হয়ে পড়েছি–সর্দার তোকেই হুকুম দিয়ে বলবে, এ রঘুয়া, মুরলীকা শির কাট লে। তোকেও তাই করতে হবে।
–ও-কথা ছেড়ে দে মুরলী-রঘুর যেন দম আটকে এল : আচ্ছা, এই যে দল বেঁধে খুন-ডাকাতি হয়, টাকা-গয়না জোগাড় হয়, তারপর সেগুলো দিয়ে কী করে?
–কেন ভাগবাটোয়ারা হয়।
–তারপর?
–সবই নিজের নিজের ভাগ নিয়ে খরচা করে, ফুর্তি করে। তা ছাড়া যাদের ঘরবাড়ি দেশ-গাঁ আছে, তারা দো-চার মাহিনার জন্যে বাড়ি চলে যায় ভালো মানুষের মতো কাজকারবারও করে। পুলিশের ঝামেলা কম হলে আবার এসে দল বাঁধে, দুতিন মাহিনা এখানে-ওখানে ডাকাতি করে ফের ঘরে ফিরে যায়।
–ঘরে তাদের মা বাপ বহিন-ভাই বালবাচ্চা আছে?
মুরলী হাসল :হ্যাঁ অনেকেরই আছে। খালি আমি আর সর্দার একদম সাফ। তখন বৃন্দা সিং ইয়া বড় এক দাড়ি লাগিয়ে লাগিয়ে সাধু সেজে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরে, কোথায় কার ঘরে কেমন সোনা-দানা আছে তার খবর নেয়। আর আমি তার চেলা হয়ে পিছে পিছে বেড়াই।