সেই কখন বন কাঁপিয়ে, শেয়ালের ডাক উঠেছিল, এখন আবার ডাকল। তার মানে, রাত দুটোর কম নয়। এই সুযোগ। এদের সঙ্গে দুমাস কাটিয়ে রাঘবের এখন আর রাতকে ভয় নেই। সে দেখেছে মানুষের চাইতে বড় কেউ নয়, দুনিয়ার সব জন্তু-জানোয়ার মানুষকেই। ভয় করে চলে। যার গায়ে জোর আছে, মনে সাহস আছে–কোনও অন্ধকার, কোনও সাপবাঘ তার পথ আটকাতে পারে না।
রঘু নিজে খাঁটিয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ওদিকের খাঁটিয়ায় মুরলী অঘোরে ঘুমুচ্ছে। এখান থেকে চলে গেলে ওর জন্যে মধ্যে মধ্যে রঘুর ভারি খারাপ লাগবে–ছেলেটা সত্যি-সত্যিই ভালোবেসেছিল ওকে। মুরলীর মা বাবা কেউ নেই, যাওয়ার কোনও জায়গা নেই, এদের। দলে থেকেই হয়তো ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে একদিন, নইলে কালাপানিতে গিয়ে পাথর। ভাঙবে।
মুরলীকে যদি সঙ্গে করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায় তো কেমন হয়? যদি বাবা-মার কাছে বলে, আমার একটি ভাই এনেছি, তোমরা ওকে আমার মতো করে মানুষ করো–তা হলে কী হয়? মাকে সে জানে–মা খুশিই হবে। কিন্তু বাবা? তার বাবাও তো ভালো লোক। শহরের সবাই বলে, রামগর্জন সিং খুব সাচ্চা আদমি, সে কখনও পচা মিঠাই বিক্রি করে না, কোনওদিন কাউকে ঠকায় না। তবু রাঘব পেটুক বলেই তাকে মাঝে মাঝে গালমন্দ করত আর নেহাত সইতে পারেনি বলেই তো অমন করে একটা রামলাঠি নিয়ে তাকে তেড়ে এসেছিল। এখন সে বুঝতে পারে, কী বিশ্রী লোভী ছিল সে, আর রাতদিন পেট-পুজোর। কথা ভাবলে মানুষ কত অপদার্থ হয়ে যায়। ভালো মানুষ বলেই রামগর্জন তাকে এতদিন। বাড়িতে রেখেছে। আর কারও বাপ হলে কবে পিটিয়ে রাস্তায় দূর করে দিত।
তা হলে মুরলীকে নিয়েই যাবে সঙ্গে করে? তাদের তো কোনও অভাব নেই। মুরলী তার আপন ভাইয়ের মতোই তো কাছে থাকতে পারবে।
ডাকবে মুরলীকে?
কিন্তু ডাকতে সাহস হল না। যদি মুরলী যেতে রাজি না হয়? যদি জানাজানি হয়ে যায়। থাক, দরকার নেই।
রঘু দরজা খুলল নিঃশব্দে। বাইরে ঝিঁঝির ডাকে ঝমঝম করছে বন। কী অন্ধকার চারদিকে! আকাশে এক-টুকরো চাঁদ হয়তো ছিল, কিন্তু গভীর কালো মেঘের তলায় সেটা ডুব দিয়েছে। আর সেই অন্ধকারে হাজার-হাজার জোনাকির সবুজ আলো জ্বলছে আর নিবছে।
একবারের জন্যে রঘুর হৃৎপিণ্ড কুঁকড়ে গেল, মনে হল, ওরা যেন বৃন্দা সিংয়ের হয়ে লাখ-লাখ চোখ মেলে পাহারা দিচ্ছে–এখনি বিকট স্বরে আকাশ কাঁপিয়ে উঠবে–সর্দার পালাচ্ছে, পালাচ্ছে—পালাচ্ছে–
রঘু থমকে দাঁড়াল।
সর্দারের ভয়ে, আর-একটা কথা তার মনে পড়েছে।
সে তো পালাবে! কিন্তু তারপর?
সর্দারের মেল-গাড়ি লুট করা তো বন্ধ থাকবে না, লাইনের জোড় খোলবার জন্যে লোকের অভাব ঘটবে না কোথাও। তেওয়ারি তো আছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে অন্য যে-কেউ চলে যাবে। গাড়ি ঠিকই ওলটাবে, মানুষ মরবে, আর
রঘুর মনে হল, সে তো পালাচ্ছে না–এতগুলো লোককে মরণের মুখে ঠেলে দিয়ে স্বার্থপরের মতো নিজের ঘরে চলে যাচ্ছে। কালকের মেল গাড়িতে তার বাব্রাও যে থাকবে না–একথাই বা কে জোর করে বলতে পারে? রঘু তো জানে, তার বাবাও নানা কাজকর্মে অনেক সময় রেলে চেপে কোথায় কোথায় চলে যায়।
কী করা যায়?
কোথাও থানায় গিয়ে খবর দেওয়া যায়, পুলিশের লোক ডেকে এনে বৃন্দা সিংকে দলবলসুদ্ধ ধরিয়ে দেওয়া চলে আজই। সকলেরই এই ঘুমন্ত অবস্থায়। কিন্তু তাই কি পারে রাঘবলাল? হোক ডাকাত, তবু তো বৃন্দা সিং তাকে ভালোবাসে, তাকে বিশ্বাস করে–শুধু শুধু নিমকহারামি করতে পারবে না।
তা হলে?
হঠাৎ আকাশের কালো মেঘে খানিক বিদ্যুৎ চমকাল, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে রঘুর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তাদের স্কুলের একজন মাস্টারমশাই ছিলেন ব্রজবাবু। ছেলেরা তাঁকে খুব পছন্দ করত আর তাঁর ক্লাসে রঘুর মতো বোকা ছেলেও কান খাড়া করে একমনে বসে থাকত।
ব্রজবাবু পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ছেলেদের নানা গল্প বলতেন। সেই গল্পেরই একটা রঘুর মনের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল।
একটি ছোট ছেলে দেখল, রেলের পুলটা বর্ষায় ভেঙে গেছে আর সে-খবর না জেনেই একখানা রেলগাড়ি ঝকঝক করে ছুটে আসছে সেই পুলের দিকে। তখন ছেলেটি করলে কী–
রঘুর ভাবনা যেন সঙ্গে সঙ্গে সব কথার জবাব পেয়ে গেল। না, সে পালাবে না, তার চাইতে ঢের বড় কাজ তার করবার আছে। সে কাজ শেষ না হলে তার ছুটি নেই। তার জন্যে যদি তার প্রাণ যায়–সেও ভালো।
রঘু বুক ভরে একবার বাইরের ভিজে বাতাস টেনে নিলে শ্বাসের সঙ্গে, একবার চোখ ভরে দেখল, অন্ধকারে লাখো লাখো সবুজ জোনাকি জ্বলছে। তারপর দরজাটা আবার বন্ধ করে নিজের চারপাইতে ফিরে এল। শুতে পারল না, সারা রাত ঠায় বসে রইল আর শুনল, জঙ্গলের ওপর দিয়ে ঝড়ের আওয়াজ তুলে একটা ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।
সেই ডাকগাড়ি!
পরের দিনটা রঘুর যেন আর কাটতে চায় না। মাথার ভেতরে সমানে ঝিমঝিম করে চলল, গলা শুকিয়ে উঠলে লাগল বার বার। ভালো করে সে খেতে পারল না, মন ভরে মুরলীর সঙ্গে গল্প করতেও পারল না।
মুরলী বললে, কী হল রে রঘুয়া?
–কুছ নেহি।
আজ রাতে কী একটা ভারি কাজ হবে–মুরলী ফিসফিসিয়ে বললে, সব তৈরি হচ্ছে।
তা হলে মুরলীকে এখনও কিছু বলেনি সর্দার! রঘু চুপ করে রইল।
মুরলী আবার বললে, তোর ভয় হচ্ছে না রঘুয়া?
রাঘব আস্তে-আস্তে বললে, যা হওয়ার হবে, মিথ্যে ভয় করে লাভ কী?