সেই সময় কে তার কানে কানে ডাকল : রঘুয়া। স্বপ্নের ঘোরে রঘু ভাবল, মা। কিন্তু স্কুলের রাস্তায় মা কেমন করে আসবে?
আবার ডাক এল : রঘু!
রঘু ধড়মড় করে উঠে বসল। না, স্কুলের রাস্তা নয়। বলরামপুরের জঙ্গলে, সেই ভাঙা বাড়ির ঘরটায় মিটমিট করে জ্বলে একটা লণ্ঠনের আলো। পাশের খাঁটিয়ায় মুরলী অঘোর ঘুমে মগ্ন। তাকে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে ডাকছে তার গুরু কিষণলাল।
–কী হয়েছে গুরুজী?
–আও মেরা সাথ।
কোথায় যেতে হবে? হঠাৎ রঘুর দারুণ ভয় ধরল। সেই কালী মন্দিরে তাকেই বলি দিতে নিয়ে যাবে নাকি এখন?
কিছুই তো বলা যায় না–সর্দারের মেজাজকে একেবারেই বিশ্বাস নেই।
কিষণ হাসল : আও, কুছ ডর নেহি!
রঘু উঠে এল। তখনও চোখ থেকে ঘুমের ঘোরটা তার ভাঙেনি, তখনও আতঙ্কে বুকের ভেতরটা তার হাপরের মতো ওঠা-পড়া করছে।
কিষণলাল রঘুর হাত ধরে বললে, সর্দার বোলায়া।
–কেন?
–জরুরি কাম হ্যায়। আও!
কিষণলাল ভরসা দিল বটে, তবে রঘুর পা কাঁপতে লাগল। একটা পুতুলের মতোই কিষণলালের পেছনে পেছনে সর্দারের ঘরে এসে ঢুকল সে।
ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে দলের সব বড়বড় জোয়ান। মাঝখানে বৃন্দা সিং। চাপা গলায় আলাপ চলছে তাদের মধ্যে।
রঘুকে দেখে সর্দারের চোখের দৃষ্টি যেন স্নেহে কোমল হয়ে গেল। বললে, আও বাচ্চা পাহালওয়ান, বৈঠো।
দলের সবাই হেসে উঠল।
রঘু ভয়ে ভয়ে বসে পড়ল কোনায়। এই সব চাঁইদের বৈঠকে কেন যে তাকে ডাকা হয়েছে তা সে বুঝতে পারল না। চিরদিনই সে আর মুরলী এসবের বাইরে থাকে।
সদর গম্ভীর হয়ে ডাকল :রঘুয়া।
–কহিয়ে সর্দার! দলে থাকতে থাকতে হিন্দীটা কিছু কিছু রপ্ত হয়ে এসেছে রাঘবের।
–তোমার সাহস আর বুদ্ধি দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। তাই একটা বড় কাজের ভার দেব তোমায়।
কিষণলাল রঘুর পিঠ চাপড়ে দিলে।
–শাবাশ রঘুয়া। সর্দার ডেকে কাজের ভার দিচ্ছে–আজ তুই জাতে উঠে গেলি।
সর্দার বললে, বলরামপুরের জঙ্গলে এই দুমাস আমরা কুটমুট বসে নেই। একটা বহুৎ ভারি মতলব আমাদের। সব ঠিক হয়ে গেছে এবার। কাল রাত দুটোর সময় ডাক-গাড়ি এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবে, তখন আমরা সেটা লুট করব।
রঘুর চোখ কপালে উঠল।
সর্দার আস্তে আস্তে বলে চলল : সে তো এমনিতে হবে না, সে-গাড়ি উল্টে দিতে হবে, অ্যাকসিডেন্ট হবে–দুচারশো আদমি মরবে–সেই মওকায় আমরা লুট করে নেব সব।
সারা ঘরটা স্থির হয়ে রইল, একটা কথা বলছে না কেই। কেবল বাইরে থেকে একটানা করাত-চেরার মতো ঝিঁঝির ডাক উঠছে। লণ্ঠনের আলো বৃন্দা সিংয়ের প্রকাণ্ড মুখোনার ওপরে, ঠিক একটা রাক্ষসের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
–তাই,–সর্দার বলে চলল : লাইনের জোর খুলে দিতে হবে, ফিসপ্লেট সরাতে হবে। ব্যস–কাম পাকা।
দলের একজন আনন্দে বলে উঠল : আউর ডাক-গাড়ি কী দৌড় ভি খতম! বহুৎ রুপিয়া মিল জায়েগা সর্দার–সোনা চাঁদি ভি আ জায়গা।
–হাঁ, আয়েগা। উসি ওয়াস্তে–সর্দার আবার রঘুর দিকে তাকাল। তুমি কাল যাবে তেওয়ারির সঙ্গে। ফিসপ্লেট সরাতে হবে, ওর সঙ্গে কাজে হাত লাগাবে তুমিও। এই কাজই তোমাকে দিলাম। ইয়াদ রাখনা–তোমাদের কাজের ওপরেই ভরসা–মেল-গাড়ি যদি বেরিয়ে যায়, সব বরবাদ হয়ে যাবে। কারণ, এই জঙ্গলে আর আমরা বেশি দিন থাকতে পাব না–ডেরা ডান্ডা তুলতে হবে আমাদের। ক্যা রঘুয়া, পারবে তো?
কিষণলালই রঘুর হয়ে জবাব দিলে। আর একবার শিষ্যের পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বললে, জরুর। কাহে নেহি? আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি সর্দার, দেখে নিয়ে।
কিন্তু একটা কথাও বলতে পারল না রাঘব। সারা শরীরটা তার জমে পাথর হয়ে গেল, কপাল বেয়ে দরদর করে নামতে লাগল ঘামের স্রোতে। মনে হতে লাগল, যেন হাত-পা বেঁধে তাকেই কেউ একটা ছুটন্ত মেল-ট্রেনের চাকার তলায় ফেলে দিয়েছে।
.
এগারো
সমস্ত দিনটা রঘুর যে কী ভাবে কাটল, সে শুধু রঘুই জানে। রাত্রে যখন সর্দারের ঘর থেকে সে বেরিয়ে এসেছিল তখন তার সামনে সারা পৃথিবীটা ঘুরছে। সবাই যত বলছে, শাবাশ রঘুয়া, ততই তার হাত-পা পেটের মধ্যে ঢুকে যেতে চাইছে।
সর্দার তাকে সম্মান দিয়েছে। এমন বাচ্চা বয়সে এত বড় খাতির এর আগে কেউ পায়নি–এমন কি মুরলীও না। ভুট্টারাম তো ওদের চাইতে বেশ বড়, তবু তাকে কোনও বিশেষ কাজে সচরাচর ডাকা হয় না। আর রাঘব এই দুমাসের মধ্যেই একেবারে সর্দারের নিজের লোক হয়ে গেছে, কিষণলাল তো তার নাম করতে অজ্ঞান!
কাজটা কী? সব চাইতে দরকারি কাজ–অর্থাৎ মেল-ট্রেন আসবার একটু আগেই লাইনের জোড় খুলে দিতে হবে। তারপর গাড়িটা উল্টে পড়বে, কয়েকশো মানুষের প্রাণ যাবে, আর সেই ফাঁকে বৃন্দা সিংয়ের দলবল গাড়িটা লুট করে নেবে।
খুন? শুধু খুন নয়–কতকগুলো নিশ্চিন্ত নিরীহ মানুষ, কত বাচ্চা ছেলে, কত মা, কত বুড়োবুড়ি প্রাণ হারাবে। যারা বাঁচবে, কারও হাত কাটা যাবে, কারও পা উড়ে যাবে। এত বড় অন্যায় কি আর আছে? রাঘব কি কখনও এমন পাপ করতে পারে।
একবার ভাবল, মুরলীকে জাগিয়ে সব বলে, কিন্তু মুরলী কী করবে? সে যে কিছুতেই এ কাজ পারবে না–একথা সদাকে গিয়ে বলবার জো নেই। বৃন্দা সিংয়ের হুকুম না
পালানোটা হয়তো এখন একেবারে অসম্ভব নয়। সবাই তাকে বিশ্বাস করে, কেউ আর তার ওপর নজর রাখছে না। আজ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কালই এখানকার আস্তানা তুলে ফেলবে বলে বাড়ির সামনেও কোনও পাহারা নেই। রঘু পালাতে পারে, সহজেই পালাতে পারে এখন।