নিরুত্তরে দুজনে দুটো সিগারেট ধরাল। হাসির কথাটা মন থেকে মুছে ফেলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।
অনাদি বললে, আমার ভাই ভালো লাগছে না একটুও।
বিরিঞ্চি সুকুঞ্চিত করলে : কেন?
–মনে হচ্ছে সুবিধে হবে না। বিপদে পড়ব।
–বিপদ?–বিরিঞ্চি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল : দুটো রিভলবার আর দুশো কার্তুজ আছে সঙ্গে। এই মেডোর দেশে এসেও যদি কাজ গুছিয়ে নিতে না পারি, তাহলে মানুষ হয়ে জমেছি কেন বলতে পারো?
–হুঁ।–অনাদি গম্ভীর হয়ে রইল।
নির্জন স্টেশনের ওপরে দুপুরের রোদ জ্বলছে। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে লাইন পেরিয়ে একটা ঢালু জমি প্রসারিত হয়ে গেছে দিগন্ত পর্যন্ত। তার ওপর জঙ্গল আর জঙ্গল। কালো কালো ডানা আকাশে মেলে দিয়ে উড়ে চলেছে শামকল পাখির ঝাঁক।
হাতের রিভলবারটা নিয়ে বিরিঞ্চি খেলা করতে লাগল। একবার তাকাল বাইরের দিকে। বললে, হাতে দুটো কাজ এখন। নিতাই সরকারের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা আদায় করতে হবে। দু নম্বর–মেল ট্রেন।
অনাদি বললে, তিন নম্বর কাজেরও দেখা পাবে। মনে করো যদি শ্ৰীমন্ত রায় এসে সামনে দাঁড়ায়–বলে–
–হ্যাং; ইয়োর শ্ৰীমন্ত রায়। বাঘের মতো গর্জন করে বিরিঞ্চি মাটিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। বললে, আসে আসুক–এই রিভলবারের মুখে–
কিন্তু এবারেও বিরিঞ্চির কথা শেষ হল না।
সমস্ত স্টেশনটা কাঁপিয়ে হঠাৎ একটা প্রচণ্ড অট্টহাসির ঝড় উঠল। হোঃ–হোঃ–হোঃ। অমানুষিক, নৃশংস আর ভয়ঙ্কর হাসি। সে-হাসিতে এই দিন-দুপুরেও দুজনের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল সজারুকাঁটার মতো।
চকিত হয়ে দুজনে পেছন ফিরে তাকাল। যা দেখল তা বিশ্বাস করবার মতো নয়। ওয়েটিং রুমের কাঁচের জানলার পাল্লার ওপর থেকে নক্ষত্র-গতিতে একখানা হাত সরে গেল। সে-হাত সাধারণ মানুষের হাতের প্রায় দ্বিগুণ। তার রং কালির মতো কালো, রোমশ, কর্কশ আর ভয়ঙ্কর।
বিস্ফারিত চোখ মেলে দুজনে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
পরক্ষণেই আর-একটা। আতঙ্কের উপর আতঙ্ক।
খোলা জানলা দিয়ে প্রকাণ্ড একটা শাদা গোলার মতো কী ছিটকে এল ওদের দিকে ক্র্যাশ করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে, তারপর ঘরময় গড়িয়ে গেল ফুটবলের মতো।
একটা নরমুণ্ড। তার বিকট দাঁতগুলো ছরকুটে আছে–যেন কামড়াতে চায়। আর তার সঙ্গে আঁটা একটা শাদা কাগজ–তার ওপরে প্রকাণ্ড একখানা হাতের ছাপ রক্তমাখা হাতের ছাপ।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই জানালার দিকে পাগলের মতো ছুটে গেল বিরিঞ্চি। বাইরে হাত বাড়িয়ে ট্রিগার টিপল রিভলবারের।
গুড়ম–গুড়ম—
সমস্ত স্টেশনটা থরথর করে উঠল। আর দূরে প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে খৈনি টিপতে লাগল গিরিধারী।
.
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সমস্ত লোক জমা হয়ে গেল ওয়েটিং রুমে। অনাদি মূৰ্ছিতের মতো বসে পড়েছে ডেক-চেয়ারে, তার মাথাটা যেন কুমোরের চাকার মতো বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে। কিন্তু বিরিঞ্চি অত সহজে বিচলিত হয়নি। শুধু মুহূর্তের জন্যে তারও শরীরটা কেমন করে উঠেছিল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে শত্রু আছে কাছাকাছি। কিন্তু সে-জন্যে পিছিয়ে গেলে চলবে না, দুশো রাউন্ড কার্তুজ তারা এনেছে রিভলবারে ব্যবহার করার জন্যে।
ওয়েটিং রুমে লোক জড়ো হওয়ার আগেই সে মড়ার মাথাটা থেকে কাগজখানা খুলে নিলে নিঃশব্দে সেটাকে পুরলে নিজের পকেটে। তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
হইহই করতে করতে ছুটে এলেন গণেশবাবু, স্টেশনের ছোঁকরা বুকিং ক্লার্ক রহমান আর পানিপাঁড়ে রাম সিং। গণেশবাবুর অবস্থা দেখলে দুঃখ হয়। স্নানের উদ্যোগ করছিলেন ভদ্রলোক, হাতে গাড়, কানে পৈতে, পরনে গামছা। সেই অবস্থাতে ছুটে এসেছেন তিনি। মোটা মানুষ, এমনিতেই হার্ট দুর্বল! এই দিন-দুপুরে রিভলবারের দু-দুটো আকাশফাটানো শব্দে তাঁর বুকের মধ্যে যে কেমন করছে সে তিনিই জানেন।
–কী হয়েছে? ব্যাপার কী?
সমস্বরে সকলের প্রশ্ন।
অনাদি কোনও কথা বলতে পারল না, জবাব দিলে বিরিঞ্চি। আঙুল বাড়িয়ে বললে, ওইটে দেখুন।
সর্বনাশ! মড়ার মাথা! তিনজনেই লাফ দিয়ে দরজার দিকে সরে গেল আতঙ্কে। সবচাইতে প্রচণ্ড লাফ দিলেন গণেশবাবু অমন মোটা শরীর নিয়ে অতবড় লাফ তিনি যে কী করে দিলেন এ একটা আশ্চর্য ব্যাপার। তাঁর সেই লক্ষদান দেখলে ক্যাঙারুরও লজ্জা হত। হাতের গাড়টা ঠাঁই করে গিয়ে লাগল পানিপাঁড়ে রাম সিংয়ের কাঁকালে, সেও আঁই আঁই আঁই দুদ্দা বলে মেঝেতে বসে পড়ল।
মিনিট-খানেক পরে একটু সামলে নিল সকলে।
কাঁপা গলায় গণেশবাবু বললেন, ওটা কী করে এল?
বিরিঞ্চি সংক্ষেপে উত্তর দিলে, জানলা দিয়ে।
–জানলা দিয়ে? কোনও লোজন–?
–নাঃ-ডেক–চেয়ারে বসে এতক্ষণ পরে সাড়া দিলে অনাদি। দুটো ঘোলাটে চোখ মেলে বললে : শুধু একখানা হাত! যেমন বিশ্রী কালো, তেমনি ভয়ঙ্কর। একখানা কালো হাত!
গণেশবাবুর বুকের রক্ত চন-চন করে উঠল। হাত দুটো থর-থর কতে কাঁপতে লাগল।
রাম সিং কাঁকালের ব্যথাটা সামলে নিয়ে বললে, রাম, রাম–ই তো কোই জিন কা কারবার হোগা মালুম হোতা!
ঠাঁই! গণেশবাবুর কাঁপা হাত আবার গাড়র ধাক্কা লাগল রাম সিংয়ের হাঁটুতে।
–আঁই হো দাদা-মর গেই রে–আর একলাফে রাম সিং বাইরে চলে গেল। গাড়টার গতিবিধি তার সুবিধাজনক মনে হচ্ছিল না।
রহমান বললে, দিন-দুপুরে ভূত! এ হতেই পারে না।