রঘু দেখল, বৃন্দা সিং দাঁড়িয়ে।
বৃন্দা সিং একটা প্রকাণ্ড চড় বসিয়ে দিল ভুট্টারামের গালে। ঢাকের চামড়া ফেটে যাওয়ার মতো আওয়াজ উঠল একটা। আর একটা চড় পড়ল, তারপরেই ভুট্টারাম লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল মাটির উপরে।
কিন্তু শুয়ে থাকতেও পারল না। একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সর্দার তক্ষুনি দাঁড় করাল তাকে। ভুট্টারামের চোখ দুটো বোজা, সারাটা শরীর তার টলছে। মুখটা ফাঁক হয়ে আছে, রক্ত দেখা যাচ্ছে দাঁতের গোড়ায় গোড়ায়।
সর্দার বললে, শাবাশ রঘুয়া। সব দেখেছি আমি। চল এখন আমার সঙ্গে। আগে ভুট্টারামের বিচার হবে, তারপর দুসরা কাজ।
আজ রাতেই এই বদমাশকে আমি বলি দেব।
ভুট্টারাম সেই অবস্থায় হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
–সর্দার মুঝে মাপ–
–মাপ! কভি নেহি! এই বাচ্চার সঙ্গে কুস্তিতে হেরে গিয়ে তুই ছোরা বের করিস। চোট্টা, ডর-পোক বদমাশ কাঁহাকা! তোর মতো লোক সঙ্গে থাকলে বৃন্দা সিংয়ের দলের বদনাম। তোকে আমি সাবাড় করে দেব।
–সর্দার!
–চোপ রহো! টুটি চেপে ধরে যেমন করে বেড়াল ইঁদুরকে ঝাঁকুনি দেয়, তেমনি করেই সর্দার তাকে ঝাঁকি দিলে। বললে, তোকে মরতে হবে। জরুর।
আর তখন রাঘবলালই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বৃন্দা সিংয়ের পায়ের কাছে।
–সর্দার, তোমার পায়ে পড়ছি, ভুট্টারামকে এবার মাপ করে দাও।
বৃন্দা সিং রঘুর দিকে তাকাল। আর রক্তমাখা দাঁতগুলো বের করে ট্যারা-ট্যারা চোখ দুটোকে মেলে ধরে স্বয়ং ভুট্টারাম হাঁ করে চেয়ে রইল রঘুর দিকে–সমস্ত ভয়-ডর ব্যথা ভুলে গিয়েই।
এমন অসম্ভব ঘটনা জীবনে সে কখনও দেখেনি।
.
দশ
ভুট্টারামের ব্যাপারটা নিয়ে খুব হইচই হল খানিকটা, আর বৃন্দা সিংয়ের আড্ডায়, রঘুর খাতিরও বেড়ে গেল সাংঘাতিক। বাচ্চা তো কেয়া–দেখা? ভুট্টারামকে কেউ পছন্দ করত না। লোকটার মন ভারি নীচ, আর ভয়ঙ্কর কুঁদুলে। কিন্তু সহজেই পার পেল না ভুট্টারাম।
প্রথমে তো রঘুর কাছে মাফ চাইতে হলই, তারপর দলের মধ্যে থেকে অকারণ গণ্ডগোল বাধানোর জন্যে তাকে পুরো তিন হাত টেনে নাক খত দিতে হল : ম্যায় ক্যায়সা কাম কভি নেহি করুঙ্গা–কভি নেই করুঙ্গা–
তবু আর রাগ রইল না ভুট্টারামের। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, রঘুর দয়াতেই এ-যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সে। নইলে যেরকম খেপে গিয়েছিল বৃন্দা সিং, তাকে নরবলি দিয়েই ছাড়ত।
সেদিন রাতের বেলা ঘরে রঘুকে একা পেয়ে ভুট্টারাম গুটিগুটি পায়ে হাজির হল তার কাছে। এ-ভাই রাঘবলাল।
ভুট্টারামের এমন চিনিমাখানো মিহি গলা যে থাকতে পারে এর আগে তা কখনও ভাবাই যায়নি। হাঁড়িচাঁচার মতো বিশ্রী আওয়াজে সে বরাবর চোখ পাকিয়ে ডেকেছে : রঘুয়া!
কিন্তু গলার মোলায়েম আওয়াজে রঘুর সন্দেহ গেল না। সাবধান হয়ে খাঁটিয়ার ওপর সোজা পিঠ খাড়া করে বসল। ভুট্টারামকে বিশ্বাস নেই–কী মতলব সে আঁটছে কে জানে!
রঘু বলল, কী চাই আবার?
ভুট্টারাম আবার সেই চিনিমাখানো আওয়াজে জানাল যে, বিশেষ কিছুই সে চাইতে আসেনি, রাঘব আজকে সর্দারের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছে। এই কৃতজ্ঞতাটাই সে ভুলতে পারছে না কিছুতেই।
-ঠিক আছে, যাও।
-না ভাই রাঘবলাল, এ-শুধু মুখের কথা নয়। তোমার দয়ার কথা ভেবে আমি তোমায় কিছু উপহার দিতে চাই।
সে কী! উপহার?
কুতার ভেতর থেকে একটা আঙটি বের করে ভুট্টারাম বললে, ইঠো তোম্ লে লো ভাইয়া! হাঁ মামুলি সোনেকা চিজ।
–আমি সোনার আঙটি দিয়ে কী করব?
–রাখবে তোমার সাছে। সকলকে বলবে, ভুট্টারাম মুঝে ই আঙগোটি দিয়া।–বলো জোর করেই রঘুর হাতে গুঁজে দিলে আঙটিটা। রঘু বুঝতে পারল, তাকে উপহার দিয়ে ভুট্টারাম সর্দারের নেকনজর ফিরে পেতে চায়।
–এ তুমি কোথায় গেলে?
–এক ডাকাইতিসে মিলা থা। এক আউরত কি হাথসে ছিন লিয়া। ভুট্টারাম হাসল।
অর্থাৎ ডাকাতি করে পেয়েছিল আর একটি মেয়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
ভুট্টারাম চলে গেলে আঙটিটার দিকে চেয়ে বসে রইল রাঘবলাল। আঙটিতে একটা লাল পাথর ছিল, সেটি যেন এক ফোঁটা রক্তের মতো হয়ে জ্বলতে লাগল তার সামনে। একজনের কত আশার জিনিস এই আঙটি–সেটা জোর করে কেড়ে এনেছে। কে জানে তাকে মেরেও ফেলেছে কি না–যা নিষ্ঠুর লোক ভুট্টারাম। রঘুর চোখে জল এল।
এই আঙটি হাতে পরবে সে–এমন পাপের জিনিস! নিজের ভবিষ্যতের চেহারাটা যেন আঙটিটার ভেতর দেখতে পেল সে। সেও ডাকাত হবে–খুনী হবে–এমনি করে পরের জিনিস কেড়ে নেবে।
রাঘবলাল আর সইতে পারল না। আঙটিটা যেন হাতের মধ্যে আগুনের মতো জ্বলতে লাগল তার। ওটাকে সে অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যেই ছুঁড়ে ফেলে দিলে।
.
রাত তখন কত কেউ জানে না। বনের ওপর থমথম করছে অন্ধকার। আকাশে মেঘ হয়ে গুমট করে আছে–একটা পাতা পর্যন্ত নড়ছে না কোথাও। শুধু করাত দিয়ে কাঠ-চেরার মতো আওয়াজ তুলে ঝিঁঝি ডাকছে, পাখির ছানারা ঘুমের মধ্যে চমকে চমকে উঠছে কখনও। একটু আগেই শেয়ালের ডাক উঠেছিল, অনেক দূর থেকে গুম গুম করে বেজে উঠেছিল বাঘের গর্জন। কিন্তু এখন কিছুই শোনা যাচ্ছে না আর।
গরমে ঘেমে-নেয়ে রাঘবলল অঘোরে ঘুমুচ্ছিল। স্বপ্ন দেখছিল, শনিবার তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, দুপুরবেলা, বই-খাতা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছে সে। রাস্তায় ধুলো উড়ছে–আমের মুকুল থেকে গন্ধ উঠছে–একটা বকুল গাছের তলায় অনেকগুলো ফুল লাল হয়ে শুকিয়ে আছে।