বৃন্দা সিং যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল : কী বলছিস?
–আমায় সত্যিই ছেড়ে দেবে? দেশে চলে যেতে দেবে?
–ভেবে দেখব! সর্দার আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। যেন নিজের সঙ্গেই কথা কইতে লাগল সে : জানিস রঘুয়া, আমিও ইচ্ছে করে ডাকু হইনি। কোনওদিন যে আমাকে এই পেশা নিতে হবে সে কথা ভাবতেও পারিনি আমি।
রঘু অবাক হয়ে সর্দারের মুখের দিকে তাকাল।
বৃন্দা সিং বলে চলল : আমার দেশ কোথায়–জানিস? রাজস্থানে। তুই বাঙাল মুলুকে থাকিস, সে-দেশের কথা তুই ভাবতেও পারবি না। শুধু বালি আর পাথর। জল নেই বললেই চলে। ফসল একরকম হয়ই না। বড় বড় শহর আছে। রাজা আছে। বড়াবড়া শেঠজী আছে। মন্দির-মঞ্জিল আছে। কিন্তু গাঁয়ের মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আমারও খাওয়া জুটত না। আমার মা জয়পুরে ভিখ মাঙতে গিয়ে এক শেঠজীর হাওয়া-গাড়ির তলায়। চাপা পড়ে মরে গেল। তখন আর মাথার ঠিক রইল না রাগে-দুঃখে আমি ডাকু হয়ে গেলাম। পেট ভরে যদি এক বেলাও রুটি খেতে পেতাম তা হলে সব অন্যরকম হয়ে যেত।
রঘু ভয়ে ভয়ে বললে, সর্দার! আমিও ডাকু হতে চাই না। আমায় ছেড়ে দাও।
হঠাৎ বৃন্দা সিংয়ের লাল-লাল ভয়ঙ্কর চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলে উঠল।
–তারপর কী করবি? বৃন্দা সিং গর্জে উঠল : পুলিশের কাছে গিয়ে বলে দিবি আমার দলের কথা? তারা আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি লটকে দিক–এই তোর মতলব?
–না সর্দার।
–না সর্দার? বাঘের ডাকের মতো ফেটে পড়ল বৃন্দা সিংয়ের গলা : গোয়েন্দা সব গোয়েন্দা! কাউকে বিশ্বাস করি না আমি। শোন রঘুয়া! তুই মুরলীর জান বাঁচিয়েছিস, আজ আমাকে বাঁচিয়েছিস। তাই এবার তোকে আমি মাপ করলাম। ফের যদি এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলবি, তা হলে তোকে সোজা কালী মাঈজীর মন্দিরে নিয়ে খতম করে দেব। ইয়াদ রাখনা-হুঁশিয়ার!
বলেই ঝড়ের মতো বন ভেঙে কোন দিকে এগিয়ে গেল। রাঘবলাল সর্দারকে আর দেখতেও পেল না।
কাঠ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। আশ্চর্য মেজাজ বৃন্দা সিংয়ের কিছু বোঝবার জো নেই। এই দিব্যি মিষ্টি মুখে কথা বলছে, তারপরেই হঠাৎ রেগে গোঁ গোঁ করে উঠল : তখন তার মুখ চোখের দিকে তাকায় কার সাধ্যি? মনে হতে থাকে, এখন সে জ্যান্ত মানুষ ধরে বাঘের মতো কচমচিয়ে চিবিয়ে খেতে পারে!
বেশ বলছিল, নিজের কথা, বলছিল রঘুকে সে ছেড়ে দেবে, কিন্তু একটু পরেই কী যে হল!
রঘু তাকিয়ে দেখল, আড্ডার কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। কিন্তু এখন আর ওখানে যেতে ইচ্ছে করল না। একটা প্রকাণ্ড আমলকী গাছে অসংখ্য ফল ধরেছে, সরু সরু পাতার আড়ালে গোছায় গোছায় আমলকী সবুজ মার্বেলের মত ঝুলছে, কয়েকটা পাকা ফল ছড়িয়ে আছে তলায়। জায়গাটা পরিষ্কার দেখে রঘু সেখানে বসে পড়ল, দুটো আমলকী কুড়িয়ে নিয়ে চিবুতে লাগল অন্যমনস্কভাবে।
এখন বেলা পড়ে এসেছে। রঘুর মনে পড়ল, এই সময় তাদের স্কুলের ড্রিল পিরিয়ড। রঘু ভালো ড্রিল করতে পারত না। অ্যাটেনশন বললে ফল ইন, রাইট টার্ন বললে, লেফট টার্ন নিত। তখন তার খিদেতে নাড়ি চিনবিনিয়ে উঠেছে, কেবল ভাবছে, বাড়িতে মা আজ কী নতুন খাবার রেখেছে তার জন্যে! কিন্তু কুস্তি লড়ে, লাঠি খেলে রঘু ভাবছে, ড্রিল করার মতো এমন ভাল জিনিসও তার ভালো লাগত না–এমনি অকর্মা ছিল সে! সাধে কি ফিগার ভুল হলে ড্রিল মাস্টার ধীরেনবাবু এসে তার কান ধরে চাঁটি লাগিয়ে দিতেন?
আবার যদি কখনও ফিরে যেতে পারি। কিন্তু বৃন্দা সিং তাকে কি আর ফিরতে দেবে? ডাকু হয়েই বোধহয় তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে শেষ পর্যন্ত।
–আব তুমকো মিলা—
রঘু চমুকে তাকাতেই দেখল, সামনে ভুট্টারাম দাঁড়িয়ে। রঘু উঠে পড়ল। আর কতগুলো উঁচু-উঁচু বিশ্রী দাঁত দেখিয়ে ভুট্টারাম বললে, সেদিন তো খুব চালাকি করে পালিয়ে গেলি মুরলীর সঙ্গে। এখন যদি তোকে পিটিয়ে তুলোধুনো করি–কী করবি?
সে-রাঘবলাল আর নয়–যে প্যাঁচার ডাকে মূছা যেত। ভুট্টারামের কথায় তার গা জ্বলে গেল।
–তুমি আমায় মারবে কেন?
–তুই আমার খাঁটিয়ায় শজারু ছাড়লি কেন? আমার পিঠ ফুটো হয়ে গেছে।
রাঘবের বলতে ইচ্ছে হল, তোমার তো গণ্ডারের চামড়া, দুটো শজারুর কাঁটায় আর কী হয় তোমার? কিন্তু সে-কথা না বলে সে জবাব দিলে : তুমি আমার গায়ে ব্যাঙ দিয়েছিলে কেন?
ভুট্টারাম দাঁত খিঁচিয়ে বললে, বেশ করেছি। এখন তোকে মেরে আমি হালুয়া করে দেব। দেখি কে বাঁচায়।
রঘু মাথা সোজা করে বললে, খবর্দার!
–খবর্দার! আচ্ছা, দেখো তব—
দুটো হাত সামনে ছড়িয়ে নিয়ে ভুট্টারাম ঝাঁপিয়ে পড়ল রঘুর ওপর। রঘু অমনি কাঠবেড়ালির মতো সড়াৎ করে সরে গেল, আর ভুট্টারাম সোজা গিয়ে ধাক্কা খেল আমলকী গাছটার সঙ্গে। চেঁচিয়ে উঠল : আরেঃ বাপ!
রঘু আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল।
ভুট্টারাম আনন্দে হেসে উঠল। উঁচু-উঁচু দাঁতগুলো চকচক করে উঠল তার। ছোরাটা তুলে সে রঘুর দিকে এগিয়ে গেল–এখুনি ওর বুকে বসিয়ে দেবে।
প্রাণের দায়ে চেঁচিয়ে উঠল রঘু : মুরলী–মুরলী–ভেইয়া–
–কোই নেহি। কোই তুমকো নেই বঁচায় গা–দাঁতে দাঁত ঘষে ভুট্টারাম ছোরাটাকে বাগিয়ে ধরল, কিন্তু ছোরা আর নামল না। তার আগেই কে তার হাত মুচড়ে ধরল। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল ভুট্টারাম, ছোরাটা মাটিতে পড়ে গেঁথে গেল।