মুরলী বললে, আমার বনে বনে ঘুরতে বেশ লাগে। তোর ভালো লাগে না?
একেবারেই নয়। কিন্তু সেকথা রাঘবলাল মুখ ফুটে বলতে পারল না।
আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা শুকনো মরা গাছ পাওয়া গেল। মুরলী বললে, এইটেকেই কাটা যাক–কী বলিস?
আচ্ছা।
মুরলী কুড়ল তুলে জোরে গাছটায় কোপ বসালো। কিন্তু কুড়লটা তখুনি টেনে তুলতে পারলে না–অনেকখানি বসে গিয়েছিল। মুরলী কুড়ল ধরে টানাটানি করছে, আর সেই তখন—
গর্—র—র্–
শুধু একবার একটা আওয়াজ, ঝোঁপ নড়বার শব্দ, তারপরেই যেন একরাশ সোনালি আগুন ঠিকরে উঠল বনের ভেতর থেকে। পরক্ষণেই যা দেখল তাতে মাথার চুল একেবারে খাড়া হয়ে গেল রঘুর। দেখলে, আর্তনাদ করে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছে মুরলী, আর তার পিঠের ওপর চেপে বসেছে বিরাট এক চিতাবাঘ। এক সারি ছোরার মতো তীক্ষ্ণ দাঁত মেলে গর্জন করছে : গর্—র—র্–
.
সাত
রঘুর চুল খাড়া হল–টিকিটাও যেন সোজা দাঁড়িয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিতেই যাচ্ছিল–হঠাৎ তার কানে এল মুরলীর চিৎকার : বাঁচাও–বাঁচাও–
সংসারে কোনও মানুষ ভীরু–কেউ সাহসী, রাত্তিরে গায়ে আরশোলা পড়লে কারও দাঁতকপাটি লাগে, কেউবা অমাবস্যার মাঝরাতে একা শ্মশানে যেতে ভয় পায় না হাতে লাঠি বাগিয়ে দশজন ডাকাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুধু কি গায়ের জোরের জন্যেই? আরে না–না। মনের জোর থাকলে শরীরে শক্তি আপনি এসে যায়। মানুষ ভীরু হয় কেন? আঁচল-চাপা হয়ে থাকে বলে, জুজুবুড়ির ভয়ে ছমছমানি লাগে–সেইজন্যে।
রাঘবেরও তাই হয়েছিল। কিন্তু তেমন অবস্থায় পড়লে ভীরুর বুকেও তিনটে হাতির বল আসে। রাঘবলাল পালাতে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল।
ওদিকে মুরলী ডাকছে : বাঁচাও—বাঁচাও–
একমিনিট কি দু মিনিট–কিংবা তাও নয়। রাঘব নিজেও জানে না কী করে অত বড় কুড়লটাকে সে মাথার ওপর তুলে ধরল। তারপরেই ঝপাংকুড়লের কোপ পড়ল সোজা বাঘটার ঘাড়ের উপর। খ্যাঁ–অ্যাঁ–অ্যাঁ খ্যাঁক–একটা আওয়াজ করল বাঘটা, মুরলীকে ছেড়ে ছিটকে সাত হাত দূরে গিয়ে পড়ল। রাঘবের মতো ছোট ছেলের হাতের ঘায়ে তার শক্ত গায়ে মারাত্মক চোখ হয়তো লাগেনি, কিন্তু যেটুকু লেগেছিল তাই যথেষ্ট। ঘা-খাওয়া বাঘ প্রায়ই রুখে দাঁড়ায় কিন্তু এই বাঘটার বোধহয় এতেই আক্কেল দাঁত গজিয়ে গিয়েছিল। আর-একবার সে ঘ্যাও বলে আওয়াজ তুলল, তারপর বনের ভিজে ভিজে কালো মাটি আর শুকনো পাতার ওপর রক্ত ছড়াতে ছড়াতে চক্ষের পলকে হাওয়া হয়ে গেল।
রাঘবের কপাল বলতে হবে। মুরলীকে ছেড়ে বাঘটা তারই ওপর চওড়া হলে কী যে ঘটত-সে কথা জোর করে বলা শক্ত।
–তুই আমায় বাঁচালি রঘু! একথা আমি কোনওদিনই ভুলব না।
কিন্তু কাকে বলছে মুরলী? হাতে কুড়লটা ধরাই আছে–সেই মরা গাছাটায় ঠেসান দিয়ে বসে পড়েছে রঘু। তার চোখ দুটো বোজা-শরীর নিঃসাড়। এতক্ষণে সে সত্যিই জ্ঞান হারিয়েছে।
মুরলী আস্তে আস্তে তাকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল : রঘুয়া–রঘুয়া–এ রাঘবলাল বনের ভেতর ঝিরঝির করে হাওয়া বইছিল, দূরে কাছে তিতিরেরা এ-ওর সঙ্গে কথা কইছিল, ঘুঘু ডাকছিল ঘুম-ঘুম্ শব্দে। ভিরমির ভাবটা কেটে গিয়ে রঘু চোখ মেলল।
তারপরই কাতর গলায় বললে, মুরলী।
মুরলী রাঘবের কাঁধে হাত বুলিয়ে বললে, ভাইয়া, এই তো আমি!
–বাঘটা কোথায়?
–তোমার চোট খেয়েই তো পালিয়েছে।
–আমার?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগল রাঘব–যেন তখনও কিছু বুঝতে পারছে না।
–আরে, বাঘটা তো হাঁ করে আমায় কামড়াতে যাচ্ছিল–একটু হলেই গলায় দাঁত বসিয়ে দিত! ঠিক সেই সময় তুই কুড়ল দিয়ে জব্বর ঘা মেরে দিলি ওকে। মনে নেই। তাইতেই ল্যাজ তুলে ছুটে পালাল।
রাঘব উঠে দাঁড়াল–চোখ কচলাল বারকয়েক। তখন তার মুরলীর কথা মনে পড়ল।
–ভাই তোমার লাগেনি তো?
–না–না, সামান্য আঁচড়ে দিয়েছে। ও কিছু নয়।
রাঘব হঠাৎ মুরলীকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে। এই কদিনেই মুরলীকে সে যে কতখানি ভালবেসে ফেলেছে, যেন এইবার বুঝতে পারল সেটা! আর তার কান্নায় মুরলীরও চোখ ছলছল করে উঠল।
মুরলী বলল, চল ভাইয়া ফিরে চল। চোট-লাগা বাঘকে বিশ্বাস নেই বিশেষ করে চিতা। ঝোঁপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আবার কখন এসে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে। তখন আর সামলানো যাবে না। এই বেলা পালাই।
বৃন্দা সিংয়ের আড্ডায় রাতারাতি নিদারুণ খাতির বেড়ে গেল রাঘবলালের।
বৃন্দা সিং তার মস্ত গোঁফজোড়ায় তা দিয়ে, হঠাৎ কোনও কথা না বলে, রাঘবকে একেবারে শূন্যে ছুঁড়ে দিলে। রঘু আঁতকে উঠে আঁই আঁই করে উঠল! তার মনে হল, আবার বোধহয় সেদিনের মতো তাকে তুলে দেওয়া হচ্ছে গাছের ডালে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও গাছ ছিল না, আর পড়তে-পড়তেই আবার তাকে লুফে নিল বৃন্দা সিং। আর ধরাম ধরাম করে গোটা কয়েক পেল্লায় চাঁটি পড়ল রাঘবের পিঠে। যেন রামা হো–রামা হো গাইবার তালে বেশ করে ঢোলক বাজিয়ে নিলে বারকয়েক।
কিন্তু রাঘবের পিঠটা ঢোলক নয়–লাগলও বিলক্ষণ। তবু রাঘব কেঁদে উঠতে পারল না। সে বুঝতে পারছিল, তাকে আদর করা হচ্ছে।
বৃন্দা সিং বললে, শাবাশ–শাবাশ, এই তো চাই! ডর-পোক হয়ে ননীর পুতলা হয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? চর্বির টিবি ছিলি, এইবার মানুষ হচ্ছিস। শেষে একদিন হয়তো তুই ই এই দলের সর্দার হয়ে উঠবি। তখন সারা হিন্দুস্থানের তোক বলবে, হাঁ ডাকু বটে রাঘবলাল–তার নাম শুনলে মিলিটারি ভি ডর খায়।