হে মা কালী! হে বাবা হনুমানজী! এই দুঃসময়ে রাঘবলালকে বাঁচাও।
এর মধ্যে একটা লাল পিঁপড়ে কুটুস করে রাঘবের কানের গোড়ায় কামড়ে দিয়েছে আর কিষণলাল আবার ক্যাঁক করে লাগিয়েছে লাঠির গুঁতো। আর তো পারা যায় না।
–উতরো না! একটু নীচে নামোডাল ধরে ঝুলে পড়ো!-মুরলী উপদেশ দিতে লাগল।
তা ছাড়া আর উপায় নেই। চেষ্টা তাকে করতেই হবে। প্রাণ দিয়ে টানাটানি পড়েছে। এখন।
প্রায় দশমিনিট ধস্তাধস্তির পর–ঝপাং।
রঘু ঠিক মাটিতে নামল না–পড়ল। তারপরে আরও মিনিট দশেক নাচানাচি করতে হল প্রাণপণে। মানে, ইচ্ছে করেই নাচল না, ওই পিঁপড়েরাই নাচিয়ে ছাড়ল তাকে। মুরলী এগিয়ে এসে কিছু পিঁপড়ে ছাড়িয়ে দিলে গা থেকে। তখন বে-দম হয়ে রাঘবলাল বসে পড়ল গাছতলায়, গায়ের চামড়া ছড়ে গেছে এখানে-ওখানে, পিঁপড়ের কামড়ে চাকা-চাকা হয়ে ফুলে উঠেছে, আর বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা কামারশালার হাপরের মতো ওঠাপড়া করছে। হায়রে ছানার জিলিপি! তোর জন্যে এত দুর্ভোগ সইতে হবে সেকথা কি রাঘবলাল স্বপ্নেও ভেবেছিল। কিন্তু বসে বসে দুঃখ করবার জো নেই। কিষণলাল এক হ্যাঁচকা টানে তাকে তুলে ফেললে।
–আও, লাঠি ধরো।
কিছুতেই নিস্তার নেই। আবার সেই কালান্তক লাঠি খেলা। ওঃ!
.
দেখতে-দেখতে কুড়িবাইশটা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রাঘবলাল অনেক দেখেছে, ঠেকেছে, অনেক শিখেছে। বুঝেছে এ বড় কঠিন ঠাঁই। এখানে মা নেই, বাবা নেই, দোকানের চাকর ছোট্ট–যে লুকিয়ে-চুরিয়ে তাকে এটা-ওটা মিঠাই খাওয়াত, সেও নেই। এমন কি স্কুলের সেই বন্ধুরাও নয়–যারা ঠাট্টা করে মানপত্র দিলেও নিরীহ, শান্ত রাঘবলালকে বেশ ভালোইবাসত। ননী, ছানা ঘি-ভাত এসবের কোনও পাটই নেই এখানে।
বৃন্দা সিং তো আছেই, তা ছাড়া আছে আরও দশ বারোজন মানুষসকলেই যেন বাঘের দোসর!
ভোরে উঠে কাঁচা ছোলা খেতে হয়, কুস্তি লড়তে হয়, লাঠি-সড়কি-তলোয়ারের খেলা শিখতে হয়। বন্দুক ছোঁড়াও শিখতে হবে এর পর। আর খাওয়া শুকনো শুকনো বড়বড় রুটি, কিছু ডাল-তরকারি আর দুধ। ট্যাঁ-ফোঁ করবার জো নেই–যে-কেউ এসে ধাঁ করে। এমন এক-একটি পেল্লায় চড় কষিয়ে দেয় যে আধঘণ্টা ধরে মাথা-ফাথা বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে থাকে। প্রথম দিনে ছোলা খেতে রাজি হয়নি বলে একজন তো তাকে ঠ্যাং ধরে গদার মতো শূন্যে তুলেছিল, একটা আছাড় দিলেই একদম ঠাণ্ডা। ভাগ্যিস মুরলী হাঁ-হাঁ করে এসে পড়েছিল, নইলে সেই দিনই রাঘবলালের হয়ে যেত।
এই বাইশ দিনে অনেকটা অভ্যেস হয়ে এসেছে। ছোলা চিবুতে ভালো না লাগলেও খুব যে খারাপ লাগে তা-ও নয়। রুটি আর তরকারি এখন গোগ্রাসেই খায়-তবে গরম ঘি-ঢালা ভাতের মতো অত বেশি খেতে পারে না। খাওয়ার পরেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না, চোখে। ঝিমুনি ধরে না। মনে হয় অনেকখানি সে দৌড়ে আসতে পারে, লাফালাফি করতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত।
শরীরটা বেশ ঝরঝরে হয়ে গেছে। ভুঁড়ি-টুঁড়িগুলো এর মধ্যে যেন চুপসে কোথায় চলে গেছে। এখন লাঠির ভারে কবজি আর ছিঁড়ে আসতে চায় না। রাঘব মাথার ওপর বনবনিয়ে ঘুরোতে পারে সেটাকে। প্যাঁচার ডাকে ভয় পাওয়া দূরে থাক, রাত্রে যখন ঘরের আশপাশ থেকে উ কা হু–উ কা হু বলে শেয়ালরা গলা ছেড়ে কী যেন জিজ্ঞেস করতে থাকে, তখন রাঘবলাল অঘোরে ঘুমোয়।
আগের সেই ভিতু, বোকা আর পেটুক রাঘবলাল অনেকটাই বদলে গেছে। এমন কি বাবা-মা বাড়ির জন্যে মধ্যে-মধ্যে খুব কান্না পেলেও এখানে সে যে খুব খারাপ আছে তা নয়। মুরলী তাকে খুব ভালোবাসে, কিষণলাল কখনও কখনও পিঠ চাপড়ে দেয়, বৃন্দা সিং-ও আর তেমন কটমট করে তার দিকে তাকায় না। আসল ভয় সেখানে নয়। রাঘবলাল জেনেছে, এরা ডাকাত। নানা জায়গায় ডাকাতি করে পুলিশের তাড়া খেতে খেতে এখন কিছুদিনের জন্য এই বলরামপুরের জঙ্গলে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। কী একটা মতলব নিয়ে কিছুদিন চুপচাপ করে রয়েছে কোনও একটা বড়গোছের কাণ্ড ঘটিয়ে এখান থেকে পালাবে। দিনের বেলা ওদের কেউ-কেউ গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর গেরুয়া পরে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরোয়–দুরের গঞ্জে যায়, দরকারি জিনিসপত্র কিনে-কেটে আনে। আর মাঝরাতে বৃন্দা সিংয়ের ঘরে বসে ফিসফিস করে কী সব আলোচনা করে। সে আলোচনা, রাঘবলাল তো দূরে থাক, মুরলীরও শোনবার জো নেই।
আর এই জন্যেই রাঘবলালের ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে, শেষ পর্যন্ত সে কিনা ডাকাতের দলে গিয়ে ভিড়ল! যে-ডাকাতরা মানুষ খুন করে, লুটতরাজ করে, ধরা পড়লে ফাঁসিতে কিংবা জেলে যায় তাদের সঙ্গে মিশে তাকে কাটাতে হচ্ছে! পারলে এই মুহূর্তে সে ছুটে পালাত। কিন্তু মুরলী তাকে বলেছে, বৃন্দা সিং মিথ্যেই শাসায়নি। তার চোখ চারদিকে খোলা। পালাবার চেষ্টা করলেই টুটি চেপে ধরবে, তারপর গভীর বনের ভেতর কোথায় একটা পোড়ো পুরনো কালীমন্দির আছে, সেইখানে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দেবে।
কী হবে রাঘবলালের? কী করবে সে?
সেদিন বিকেলে বসে বসে এইসব কথাই সে ভাবছে, এমন সময় মুরলী এল। দুটো কুড়ল তার দুহাতে।
বললে, চল রঘুয়া।
–কোথায় যেতে হবে?
–সর্দার বলেছে, রান্নার কাঠ নেই। বন থেকে কেটে আনতে হবে।
দুজনে বেরিয়ে পড়ল।
এর আগে এত গভীর বনের ভেতরে রঘু কোনওদিন ঢোকেনি। বড় বড় গাছের ছায়া কী অন্ধকার হয়ে আছে এখানে ওখানে। পায়ের নীচে কী স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা মাটি। কত লতা, কত ঝোঁপঝাড়, কত রকমের ফুল ফুটেছে। তার ভেতরে ঝাঁটি ফুলগুলোকে রাঘবলাল চেনে, তাদের গন্ধে বন যেন ভরে রয়েছে। কোথাও বা কালো ভিজে মাটি ছেয়ে শিমুলের ফুল ঝরেছে-যেন বনের মধ্যে কে একখানা লাল কার্পেট পেতে রেখেছে। টুই-টুই করে মিষ্টি গলায় কী একটা পাখি ডেকে চলেছে একটানা।