–আমি এখুনি আসছি–বটে চট করে কিষণলাল আবার সেই ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। রঘু দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল চারদিকে। চোখে পড়ল, খানিক দূরে একটা শালগাছের ওপর থেকে তিনটে বানর একমনে তাকে দেখছে। একটা আবার চোখ পিটপিট করে তাকে ভেংচে দিলে।
ভ্যাংচাক যত খুশি। অন্য জায়গা হলে রঘু এতক্ষণে দু-চারটে ঢিল ছুঁড়ে দিত, কিন্তু বিপাকে পড়লে সবই সইতে হয়। রঘু মুখ হাঁড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল।
কিণষলাল ফিরে এল। তার দু হাতে দুটো লাঠি। একটা প্রকাণ্ড, আর-একটা তার চাইতে একটু ছোট। মতলব কী? ওই লাঠি দুটো দিয়ে ঠ্যাঙাবে নাকি তাকে? কিন্তু দুটোর দরকার কী, একটার এক ঘা খেলেই তো রঘু চিরকালের মতো ঠাণ্ডা।
কিন্তু কিষণলাল তাকে ঠ্যাঙাল না। সামনে এসে ছোট লাঠিটা তার দিকে এগিয়ে ধরল।
–নে।
রঘুকে নিতে হল।
লাঠি খেলেছিস কোনওদিন?
–না।
–কুস্তি করেছিস?
–না।
–হুঁ! তাই এই বয়সেই পেটে অমন করে চর্বি গজিয়েছে, বুকটা হয়েছে পায়রার মতো। তিনদিনে আমি তোকে ঠিক করে দিচ্ছি। এবার লাঠিটা ধর।
রঘু লাঠির গোড়াটা ধরল।
–বেকুব কাঁহাকা? ও-ভাবে নয়। দেড় হাত বাদ দিয়ে তারপর দু পাশে মুঠো করে ধর। ধরেছিস? এইবারে লাঠি তোল!–তোল বললেই তোলা যায় নাকি? একটা বাঁশের লাঠির যে এমন নিদারুণ ওজন হতে পারে, রঘু সেটা এই প্রথম বুঝতে পারল। যেন ভীমের গদা তুলেছে এমনি মনে হল, টনটনিয়ে উঠল হাতের কবজি।
–ঠিক হ্যায়! এইবার লাগা আমার লাঠির সঙ্গে। আওর জোরসে! খালি ঘি-মিঠাই খাস, একটু তাগদ নেই শরীরে? হুঁ–ঠিক হয়েছে। কারও মাথায় মারতে হলে কিংবা কেউ মাথায় মারতে এলে–এমনি করে মারবি। এইভাবে আটকে দিবি। একেই বলে শির-সমঝা?
আর সমঝা! এক শিরের ধাক্কাতেই রঘুর শির ঝনঝন করছে তখন! আর কী এই লাঠিটা। রঘুর কাঁধ থেকে হাত দুটো ছিঁড়ে পড়বার জো হল।
কিষণলাল বললে, লাঠি ফেক–
লাঠি ফেক, কথাটার মানে হল, লাঠিটা এগিয়ে নিয়ে ধরে ছোড়বার ভঙ্গিতে জোরে তার মাথাটা মাটিতে ঠেকানো। কিন্তু ফে কথাটার অর্থ রঘু সোজাসুজি বুঝে নিল। তৎক্ষণাৎ হাত থেকে ছুঁড়ে দিলে লাঠিটা, আর সেটা সোজা গিয়ে ধাঁই করে কিষণলালের হাঁটুর ওপর পড়ল।
–আরে বাপ, মার দিয়া! বলে হাহাকার করে উঠল কিষণলাল। হাঁটু চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল কিছুক্ষণ, বিশ্রী মুখ করে চোট-খাওয়া জায়গাটা ডলাই-মলাই করল, তারপর উঠে দাঁড়াল। তখন তার দাঁত কড়কড় করছে, তার কটা চুলে রোদ পড়ে তামার কুচির মতো জ্বলছে আর দুটো ট্যারা চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।
–উল্লু-ভাল্লু—গড্ডর–খড্ডর কাঁহাকা—
উল্ল, ভাল্লু, গড্ডর–এ-সবের মানে বোঝা যায়, কিন্তু খচ্চর যে কী ব্যাপার সেইটেই বুঝতে চেষ্টা করছিল রঘু। তার আগেই বাঘের মতো তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিষণলাল। দুটো লম্বা-লম্বা হাতে স্রেফ একটা বেড়াল-ছানার মতো মাটি তুলে নিলে, তারপর সোজা ছুঁড়ে দিলে ওপর দিকে।
কাঁউ কাঁউ করে একটা আওয়াজ বেরুল রঘুর গলা দিয়ে। আর পরক্ষণেই টের পেল মাটি থেকে হাত-সাতেক ওপরে একটা গাছের ডালে সে সওয়ার হয়েছে। তখুনি নীচে পড়ে যাচ্ছিল, প্রাণপণে ডালটাকে চেপে ধরে তার ওপর শুয়ে পড়ল।
নীচে থেকে হা-হা করে হেসে উঠল কিষণলাল। বললে, আব রহো, হঁয়াই রহো।
তা ছাড়া আর কী করতে পারে রঘু? জীবনে সে কোনওদিন গাছে চড়েনি–এমনকি ঘুড়ি ধরবার লোভেও নয়। চিরকালই সে বাপ-মায়ের আদরের দুলাল, ননীর পুতুল। এই ডাল থেকে কেমন করে যে মাটিতে নামবে সেটা ভাবতেই মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল তার।
আর তখন—
পাতার আড়াল থেকে হাজারখানেক লাল পিঁপড়ে বেরিয়ে সবেগে তাকে আক্রমণ করল। তাদের নিজস্ব দুর্গে এই অনধিকারীর প্রবেশ তারা কোনওমতেই সহ্য করতে রাজি নয়।
.
ছয়
কিষণলাল আবার গলা ফাটিয়ে হাসল কিছুক্ষণ।
— হো–হো, দেখো দেখো। পেরকা উপর বান্দর কেইসে বৈঠা হ্যা।
পের অর্থাৎ গাছের ওপর বাঁদর বসে আছে। কিন্তু রাঘবলাল আর সত্যিই কিছু বানর নয় তা হলে লাফে লাফে এ-ডাল থেকে ও-ডালে সে হাওয়া হয়ে যেতে পারত। তার বদলে চোখ কপালে তুলে সে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে রইল, আর দলে-দলে লাল পিঁপড়ে এসে–বাবা রে–মা রে গেলুম রে–
গোলমাল শুনে মুরলী বেরিয়ে এসেছিল। এই ছেলেটাকে রঘুর ভালো মনে হয়েছিল, ভেবেছিল, বিপদে-আপদে অন্তত মুরলীর কাছে আশ্রয় পাবে সে। কিন্তু এ কী বিশ্বাসঘাতকতা! সংসারে কাউকে যে চেনবার জো নেই! মুরলীও হাসছে। কালো মুখের ভেতর থেকে সাদা সাদা দাঁত বের করে সমানে হেসে চলেছে। রঘু আর্তনাদ করে উঠল : এই ভাই মুরলী, চুট্টি (পিঁপড়ে) আমাকে খেয়ে ফেললে!
–তো উতরো না। নেমে এস।
–কেমন করে নামব?
–কোশিস কর।
কী করে কোশিস করে রঘু? একেবারে ননীর পুতুল। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, মোটা হয়েছে, আর পনেরো বছর বয়সেও প্যাঁচার ডাকে ভয় পেয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরেছে। গাছ থেকে নামা কি তার কাজ?
–উতরো–উতরো বলে কিষণলাল তার লম্বা লাঠিটা দিয়ে একটা খোঁচা লাগিয়ে দিল রঘুর পেটে। রঘু গোঁ গোঁ করে উঠল।
একেবারে দুমুখো আক্রমণ! গাছে লাল পিঁপড়ের ব্যাটেলিয়ান, তলা থেকে লাঠির গুঁত। আর ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল, মাথার একটু ওপরে গোটা-চারেক বাঁদর তাকে ভেংচি কাটছে। তাদের ভাবভঙ্গি সন্দেহজনক। ওই চারটিতে মিলে যদি খ্যাঁচখ্যাঁচিয়ে তাকে আঁচড়ে দেয়, তা হলে গায়ের ছাল-চামড়া বলে কিছু আর থাকবে না।