রঘুর ইচ্ছে করল, খোলা দরজাটা দিয়ে এক ছুটে বাইরে পালিয়ে যায় সে। তার মন বলছিল, বাবু রাঘবলাল, এ-জায়গাটা একদম ভালো নয়। যদি প্রাণ বাঁচাতে চাও, তা হলে তিন লাফে উধাও হও এখান থেকে। কিন্তু ইচ্ছে সত্ত্বেও সে পালাতে পারল না। একে তো ভয়ে, ক্লান্তিতে সারা শরীর অসাড় হয়ে গেছে, তার ওপর সেই প্রচণ্ড খিদে। চম্পতিয়ার ছাতুর তাল কখন যে হোমিওপ্যাথিক বড়ি হয়ে তার পেটের অতলে অদৃশ্য হয়েছে, তা সে নিজেও জানে না। রাঘব বুঝতে পারল, সেই লাল-লাল চোখওলা বিকট চেহারার লোকটাই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। লোকটার কথা মনে পড়তেই তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভয়ে ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল। কিন্তু তখুনি পেটের আগুন-জ্বলা খিদেটা চাঁই চাঁই করে বলে উঠল : পাহাড় খাই, গাছ খাই, লোহা-লক্কড় যা পাই তাই খাই।
এনেছে যখন, তখন ভূত হোক, যা-ই হোক, কিছু নিশ্চয় তাকে খেতে দেবেই। আর, কিছু খেতে পেলে এমনিতেই যখন সে মারা যাবে, তখন খেয়ে-দেয়ে মরাই ভাল। কিন্তু যদি সত্যিই লোকটা রাক্ষস হয়? যদি তাকে একটা কাঁচা নরমুণ্ড এনে খেতে দেয়? কিংবা যদি সত্যিই তার মুণ্ডুটাই কচমচ করে–খোলা দরজার একটা পাটি বাতাসে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল সেটা। আর বিষম ভয়ে ওরে বাবা বলে রঘু একটা লাফ মারল।
এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বুদ্ধু কাঁহাকা।
রাঘবলাল দেখল, এবার যে ঘরে ঢুকেছে তাকে দেখে ঠিক রাক্ষস বলে বোধ হচ্ছে না। তার চাইতে বয়সে একটু বড়, কালো মিশমিশে একটি ছেলে। অসম্ভব জোয়ান, চওড়া বুক, লোহার শাবলের মতো দুখানা লম্বা লম্বা হাত। ইচ্ছে হলে এ-ও এক আছাড়ে তাকে চাপাটি বানিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ছেলেটা হাসছে, কালো মুখের ভেতর চকচক করছে শাদা দাঁতের সারি।
–আরে, এত ডর খাচ্ছিস কেন? আমি তোর সঙ্গে গল্প করতে এলুম।
রঘু এবার ভয় পেল না বটে, কিন্তু বেশি ভরসাও পেল না। টুক করে আবার নিজের জায়গাতে বসে পড়ল, আর ছেলেটা তার মুখোমুখি বসল একটা খাঁটিয়ার ওপর।
–আমি কোথায় এসেছি?–এতক্ষণে সাহস করে জিজ্ঞেস করল রাঘবলাল।
–কোথায় এসেছিস? ছেলেটা আবার হাসল, তা ভালো জায়গাতেই ভিড়েছিস এসে। এর নাম বলরামপুরের শালবন। সহজে কেউ এ বনের ত্রিসীমানা মাড়ায় না।
–তবে তোমরা কেন এখানে থাকো?
–কেন থাকি? জানতে পারবি একটু পরেই। তারপর আগে তোর কথা শুনি। কে তুই?
–আমি রাঘবলাল সিং। সবাই রঘু বলে ডাকে।
–আমিও রঘুই বলব। তোর কে কে আছে?
–বাবা-মা সবাই। আমি আবার তাদের কাছে ফিরে যাব। বলতে বলতে রঘুর চোখে জল এসে গেল।আমি কিরিয়া করে বলছি, আর কখনও আমি ছানার জিলিপি চুরি করে খাব না।
–চুরি করে খেয়েছিলি?
–সেজন্যেই তো! বাবা মস্ত একটা লাঠি তেড়ে এল। তারপর—
ছেলেটা বললে, হুঁ, বলে যা।
চোখের জল মুছতে মুছতে রঘু নিজের করুণ কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করলে।
শুনতে শুনতে ছেলেটা হাসছিল, শেষ পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বললে, কাজ ভালো করিসনি। বাপ-মাকে ছেড়ে পালিয়ে আসা খুব খারাপ। আমিও তাই করেছিলাম, তারপর–
–তুমিও পালিয়েছিলে! রঘু কৌতূহলে সোজা হয়ে উঠে বসল।
ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, এখন থাক এসব কথা। তুই তো কাল থেকে ভুখা আছিস দেখছি। কিছু খাবি?
–খিদেয় মরে যাচ্ছি ভাই!
–তবে বোস, আমি খাবার নিয়ে আসি। কিন্তু খবর্দার, ঘর থেকে বেরুবি না। ভারি মুস্কিলে পড়বি তা হলে।
ছেলেটা বেরিয়ে গেল।
হাঁ করে বসে রইল রঘু। মুস্কিল? সেই ভয়ঙ্কর লোকটা কে? গেলই বা কোথায়? বলরামপুরের শালবনের মানে কী? কেন লোকে এর ত্রিসীমানায় পা দেয় না? এই ছেলেটাকে দেখে তো ভয়ের কিছু মনে হল না তার। তবে ঘরের বাইরে যেতে বারণ করছে। কেন? কী আছে বাইরে? জিন-পরী? বাঘ-ভাল্লুক?
রঘু দেখতে লাগল, সামনে মাকড়সার জালে রোদ পড়ে রুপোর তারের মতো ঝিলমিল করছে। আর সেই বিকট কালো মাকড়সাটা যেন কুতকুতে চোখ মেলে চেয়ে আছে তার দিকেই। হাওয়ার ধাক্কায় জানালার ভাঙা পাল্লাটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে শব্দ করছে সমানে।
মনের মধ্যে কে যেন ডেকে বললে, এখন পালাও রাঘবলাল, এখনও সময় আছে। কিন্তু পালাবার সাধ্য কী? ছেলেটা খাবার আনতে গেছে, না-খেয়ে এক পা-ও সে নড়তে পারবে না। তারপর ঘরের বাইরে ভূতপেত্নী, সাপবাঘ কী যে থাবা পেতে বসে আছে কে জানে! রঘু ঘামতে লাগল।
ছেলেটা ফিরে এল। একটা কলাই করা থালায় কয়েকটা লাড়ু, গোটা চারেক কলা আর পেতলের গ্লাসে এক গ্লাস দুধ।
বললে–খা লে। আমার খাবারটা তোকে দিচ্ছি।
–সে কি! তুমি কী খাবেলাড়ুতে হাত দিয়েও রাঘবলাল হাত গুটিয়ে নিলে।
–আমার জন্যে তোকে ভাবতে হবে না; আমার দুসরা ব্যবস্থা আছে। তুই খা!
আর বলতে হল না। রাঘব বাঘের মতো খাবারগুলোর ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।
খাওয়া শেষ করে দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়েছে, এমন সময়–
আরে বাঃ বাঃ চিড়িয়া যে দানাপানি খাচ্ছে দেখছি।
বিষম চমকে উঠে রঘু দরজার দিকে তাকাল। তিনটে গুণ্ডা জোয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে। সকলের সামনে সেই লোকটা–যে ঘরের ভেতরে রঘুর টুটি চেপে ধরেছিল।
লোকটা সেই করাত-চেরা আওয়াজে আবার ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বললে, লে–লে শেষ খাওয়াটা খা লে! তারপর তোকে সাবাড় করব।