গণেশবাবুর ঘাম ছুটতে লাগল। সাসপেক্টেড খুন, প্রচুর টাকা চুরি এবং রাজনৈতিক গণ্ডগোল। ভয়ে তাঁর তোতলামি বেরিয়ে গেল : আ–আ–আমি ক্-ক্-কী সাহায্য করব?
–সে আমরা দেখব। ভাবনার কোনও কারণ নেই আপনার। যদি কাজটা করে ফেলতে পারি, আপনিও পুরস্কারের অংশ পাবেন।
পুরস্কারের অংশ! সঙ্গে সঙ্গে গণেশবাবু শিউরে উঠলেন। পুরস্কার। কালো হাতও তাঁকে বলে গেছে পুরস্কার দেবে। কিন্তু পুরস্কারের নমুনা যা দেখা যাচ্ছে, এখন ব্ৰহ্মতালু ফুড়ে প্রাণটা বেরিয়ে না গেলেই তিনি বাঁচেন। উঃ গোমেজ…হতভাগা গোমেজ! তার জন্যেই না তাঁকে আজ এই দুর্বিপাক ভোগ করতে হচ্ছে।
গণেশবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন। সাহেবি পোশাক পরা যুবকটি বললে, আমাদের পরিচয়টাও আপনার জানা দরকার। আমি এ-লাইনে ইন্সপেক্টর, অনাদি ঘোষাল আমার নাম। আর ইনি বিরিঞ্চি চক্রবর্তী, আমার সহকর্মী।
গণেশবাবু এতক্ষণে যেন কথা খুঁজে পেলেন।
–তা হলে আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্তটা
–কিচ্ছু ব্যস্ত হবেন না, আমাদের সঙ্গে চাল-ডাল, আলু আর কুকার আছে, ওতেই চলে যাবে। আপনি একটু জলের বন্দোবস্ত
–না, না–সে কি হয়।–হনহন করে গণেশবাবু চলে গেলেন। ভয়, অস্বস্তি আর অশান্তিতে তাঁর সমস্ত মনটা কলাপাতার মতো কাঁপছে।
গণেশবাবু বেরিয়ে যেতে অনাদি আর বিরিঞ্চি ঘন হয়ে বসল।
অনাদি বলল, কেমন দেখলে হে ভদ্রলোককে?
বিরিঞ্চি চট করে উঠে গেল। একবার মুখ বাড়িয়ে দেখে নিলে কেউ আছে কি না। তারপর দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এল অনাদির কাছে।
–গণেশবাবুর কথা বলছিলে তো? লোকটা একেবারে গবেট!
–কাজ হবে?
–হুঁ অনায়াসে। মাথায় কাঁটাল তো দুরের কথা, নারকেল আছড়ে ভাঙলেও টু করবে।
–এক ঢিলে দুপাখি মারতে হবে। শেয়ারে অন্তত পাঁচ হাজার করে আমাদের পাওয়া উচিত, কী বলে?
–নিশ্চয়, আর মেল ট্রেন থেকে যা পাওয়া যায় সেটা উপরি।
অনাদি আর-একটা সিগারেট ধরাল। চিন্তিত মুখে বললে, কিন্তু বড্ড দুঃসাহসিক হচ্ছে। শেষরক্ষা করতে পারলে হয়। তা ছাড়া, আমার মনে হয় শ্রীমন্ত রায় বেঁচে আছে।
–অসম্ভব। আমার সামনেই সে ছোরা খেয়ে গিয়েছিল মাটিতে–রক্তে ভেসে গিয়েছিল সব। আর বেঁচেই যদি থাকে–তাতেই বা ক্ষতি কী। পঞ্চাশ রাউন্ড করে রিভলবারে গুলি আছে আমাদের, ভুলো না—হাঃ—হাঃ–হাঃ। বিরিঞ্চি রাক্ষসের মতো হেসে উঠল।
–হাঃ—হাঃ—হাঃ—
পরক্ষণেই বাইরে থেকে তেমনি একটা হাসির প্রতিধ্বনি।
অনাদি আর বিরিঞ্চি একসঙ্গেই লাফিয়ে উঠল দুজনে। মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করলে বিরিঞ্চি। দুজনের মুখ থেকেই সমস্বরে বেরোল : কে হাসল অমন করে?
সবেগে দুজনে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ছাইয়ের মতো বিবর্ণ হয়ে গেছে তাদের চেহারা।
নির্জন স্টেশন। দুপুরের রোদে তার কাঁকর আর লাইনের ইস্পাত জ্বলছে। ওপাশে ঢালু জমিতে যতদূর চোখ যায় বিল আর জঙ্গল। স্টেশনমাস্টারের ঘরে লোক নেই, শুধু একটা রেলের কুলি প্ল্যাটফর্ম ঝাঁট দিচ্ছে মন দিয়ে। বুড়ো মানুষ, মাথার চুলগুলো শাদা। এত নির্বিকার, যে…
বিরিঞ্চি বাঘের মতো গলায় ডাকল, এই কুলি।
কুলিটা দাঁড়িয়ে উঠে একটা সেলাম ঠুকল। বললে, ক্যা হুকুম হুজুর।
–কে এখানে হাসল?
–কোই নেই হুজুর।
–কোই নেই?
–না হুজুর।
–হাসি শোনোনি? নেহি হুজুর। আপনোককা ভুল হুয়া হোগা।
–ভুল হুয়া হোগা। দুজনেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল কুলিটার দিকে। ভুল হবে? দুজনেরই একসঙ্গে? কেমন করে সম্ভব। তবে কি প্রতিধ্বনি? কিন্তু–
–তোমার নাম কী?
–গিরিধারী হুজুর। আজ দশ বছরের বেশি হল এই টিশনে আছি।
–আচ্ছা যাও।
–সেলাম হুজুর!-ঝাঁটাটা তুলে নিয়ে গিরিধারী চলে গেল।
ওয়েটিং রুমের বাইরে অনাদি আর বিরিঞ্চি এ-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পাথরের গড়া মূর্তির মতো ভাষা জোগাচ্ছে না।
.
চার
মিনিট পাঁচেক প্ল্যাটফর্মে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনাদি আর বিরিঞ্চি। দুজনেই কি একসঙ্গে ভুল শুনল? তাও কি সম্ভব? সিল্কের পাঞ্জাবির নীচে হুলো বেড়ালের মতো বিরিঞ্চির মাংসল পেশল শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে। হাতের মুঠোর মধ্যে রিভলবারটা কেমন একটা শব্দ করল–যেন দাঁত কড়কড় করছে। যাকে সামনে পাবে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে তাকে।
অনাদির মুখটা যেন পাঙাশ হয়ে গেছে। হাঁটু দুটো কাঁপছে ঠকঠক করে। ফিসফিস করে অনাদি বললে, ও কে হাসল? শ্ৰীমন্ত রায়?
কিন্তু বিরিঞ্চি নিজেকে সামলে নিলে। হঠাৎ অনাদির কাঁধে মস্ত বড় থাবড়া দিলে একটা।
–খেপেছ তুমি? যে-লোক আমার সামনে মরে গেছে সে এখানে আসবে কেমন করে?
–কিন্তু সত্যিই মরেছে তো?
বিরিঞ্চি যেন ধমক দিয়ে উঠল, ওসব কী কুসংস্কার তোমার? মরেনি তো মরেনি। তাই বলে সে এখানে এসে জুটবে কেমন করে?
–তা হলে ও-হাসি কার?
–কোনও পাগল-টাগলের হবে বোধহয়।
–বোধহয়।
মনের দিক থেকে এ-ছাড়া সান্ত্বনা পাওয়ার কিছু ছিল না।
মেঘের মত মুখ নিয়ে দুজনে ওয়েটিং রুমে ঢুকল। বিরিঞ্চির সমস্ত কপাল চিন্তায় রেখায়িত হয়ে উঠেছে–অনাদির চেহারায় এখনও স্বাভাবিকতা ফুটে ওঠেনি। ঘরে ঢুকে অনাদি ডেক-চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্তের মতো শুয়ে পড়ল আর বিরিঞ্চি একটা টেবিলের ওপরে পিঠ খাড়া করে বসে কী যেন চিন্তা করতে লাগল।
বাইরে রোদ ঝাঁ-ঝাঁ করছে। রেললাইনের পাশে টেলিগ্রাফের তারে একটা শঙ্খচিল চ্যাঁ-চ্যাঁ করে উঠল–ভারি অলুক্ষণে ডাক। রঙ্কিণী কালীর থানের ওপরে ঝাঁকড়া বটগাছটা অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে বাতাসে তার পাতাগুলো ঝরঝর করছিল।