কিন্তু এ-গাড়ি কি আর থামবে না? সেই যে তখন থেকে চলছে–সেচলার যেন আর বিরাম নেই। অন্ধকার ছুটছে, গাছপালা ছুটছে, আগুনের ফুলকির ঝড় উঠছে, গুমগুম করে পেরিয়ে যাচ্ছে রেলের পুল, দু-একটা ছোট-ছোট আলো দেখা দিয়েই ঘুরপাক খেয়ে কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছে। পর-পর তিন-চারটি স্টেশন চলেও গেল কিন্তু মালগাড়ি একটানা ছুটছেই আর ছুটছেই। তার থামবার কোনও লক্ষণ নেই–কোথাও যে আদৌ থামবে, এমনও মনে হচ্ছে না।
যদি না থামে? যদি একটানা চলতে চলতে দিল্লি-আগ্রা-মোরাদাবাদ-বোম্বাই সব পেরিয়ে যেখানে খুশি চলে যায়? তা হলে? তা হলে কেমন করে দেশে ফিরবে রাঘবলাল? বাবার দোকানের রসগোল্লা-চমচম-বেদে-জিলিপিসন্দেশ-মনোহ-খাস্তা কচুরিগরম সিঙারা-মতিচুর সে কি আর খেতে পাবে কোনওদিন? আর কি কোনও আশা আছে?
রাঘবলাল অঝোরে কাঁদতে লাগল।
বাবা, তোমার কাছে মাফ চাইছি। তুমি এসে এখান থেকে আমায় নিয়ে যাও। যত খুশি লাঠিপেটা কর, আমার কোনও আপত্তি নেই। এই গোরুদের গাড়ি থেকে–এই চলতি ট্রেন থেকে আমায় উদ্ধার করো।
এদিকে গোরুর জিভ ঘাড় থেকে গলায় নামল। প্রথম-প্রথম যত বিশ্রী বোধ হচ্ছিল এখন আর তেমন লাগছে না। বরং বেশ একটুখানি আমেজ হচ্ছে তার। কাঁদতে কাঁদতেই কখন তার চোখ বুজে এল, তারপর এক ফাঁকে বিচালির গাদার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
.
আবার যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখল, ট্রেন থেমেছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটেছে, পাশে বন-জঙ্গলের মাথার ওপর রোদের লাল আভা একটুখানি লেগেছে কেবল। রেললাইনের দুধারে গাছপালার ওপর পাখিরা কিচির-মিচির করছে।
রাঘব তাকিয়ে দেখল, স্টেশন নেই। বুঝল, সিগন্যাল ডাউন হয়নি, গাড়ি কোনও স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রাঘবের মনে হল এই সব চাইতে ভাল সুযোগ। স্টেশনে নামলেই তো টিকেট চাইবে, গোরুদের রিজার্ভ গাড়িতে চেপে এসেছে বলে ডবল ভাড়াই চাইবে কি না কে জানে? তার চাইতে এই বেলাই সোজা চম্পট দেওয়া ভালো। যা ভাবা সেই কাজ। চারদিকে বেশ করে দেখে নিয়ে সে টুপ করে একটা লাফ দিয়ে নীচে পড়ল। নুড়িগুলোতে একটু চোট লাগল বটে, কিন্তু সেটা এমন কিছু বেশি নয়। তারপরেই টেনে দৌড়। চোখের পলকে তারের বেড়া টপকে একেবারে রেললাইনের বিপজ্জনক সীমানার বাইরে।
গাড়ি থেকে একটা গোর ডাকল : হাম্বা! যেন বললে, কোথা যাস বাবা, ফিরে আয়।
কিন্তু রাঘব আর ফিরল না। চক্ষের পলকে কাঁটাগাছের ঝোঁপ, রেলের শুকনো নয়ানজুলি, টেলিগ্রাফের পোস্ট-সব পার হয়ে একটা পায়ে-চলা সরু পথ ধরে সে ছুটতে। লাগল। গাড়ির ইঞ্জিনের ভোঁ শুনল, একবার দেখল ট্রেনটা আস্তে-আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, দু-তিনটে গোরু যেন কান তুলে এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে, থাকুক তাকিয়ে রাঘব। আর ওদের গ্রাহ্য করে না।
রাঘব ছুটল–প্রায় মাইলখানেক দমবন্ধ করে ছুটল। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায়।
এ সে কোথায় এল!
গ্রাম নেই–মানুষজনের চিহ্ন নেই–এ যে অথই জঙ্গল। দুধারে সারি সারি ঝাঁকড়া গাছ, প্রথম ভোরের আলো এখনও ঢুকতে পারেনি তাদের ভেতরে। পায়ে-চলা পথটা ভিজে ভিজে মাটির ভেতর মুছে গেছে, চারদিকে থমথমে ছায়া। শুধু মাথার ওপরে অসংখ্য পাখির চিৎকার। এ কোথায় এল রাঘব! এখানে যে তাকে বাঘে-ভাল্লুকে ধরে খাবে!
এর চাইতে যে রেলগাড়িও ভাল ছিল।
যে-পথ দিয়ে এসেছে, ভাবল সে পথেই ফিরে যায়। কিন্তু কোথায় পথ? চারদিকেই যে ঘন কালো জঙ্গল!
এখন–এখন কী হবে?
রাঘবলাল আবার ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল।
–তু কোন্ হো?
নিদারুণ চমকে রাঘব একটা লাফ মারল।
আর সেই সময় কার একটা লোহার থাবার মতো হাত শক্ত করে কাঁধটা চেপে ধরল তার।
আর একেবারে হাঁড়িচাঁচার গলার মতো কর্কশ আওয়াজ তুলে কে জিজ্ঞেস করলে, আরে রোতা কেঁউ (কাঁদছিস কেন?)? তু কোন হো (তুই কে?)?
রাঘব তাকিয়ে দেখল, মানুষই বটে, কিন্তু কী রকম মানুষ! প্রকাণ্ড মাথায় আরও প্রকাণ্ড পাগড়ি, কান পর্যন্ত মোটা গোঁফ–দুটো লাল টকটকে বিকট চোখ মেলে ঠিক বাঘের মতোই তাকিয়ে আছে তার দিকে।
.
চার
দারুণ ভয়ে রঘু মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, সেই ভয়ঙ্কর লোকটা লোহার মতো শক্ত হাতে তার ঘাড় চেপে ধরে বললে, এই, খাড়া রহো!
খাড়া দাঁড়িয়ে থাকার জো রঘুর ছিল না। মনে হচ্ছিল, তার পা দুটো স্রেফ শোলার মতো হালকা হয়ে হাওয়ায় ভাসছে। আসলে রঘু হাওয়াতেই ভাসছিল। সেই ভয়ঙ্কর লোকটা তাকে মাটি থেকে তুলে ধরে বেড়ালছানার মতো শূন্যে দোলাচ্ছিল।
রঘু কেবল বলতে পারল : আঁ–আঁ–আঁ–
আঁ-আঁ? আচ্ছা চল আমার সঙ্গে। পিছে বোঝা যাবে।
লোকটা রঘুর ঘাড় ছেড়ে দিলে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা কাটা কুমড়োর মতো ধপাৎ করে স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপর আছড়ে পড়ল রঘু।
সেই লোকটা তখন লাল-লাল চোখ দুটো পাকিয়ে, করাতকলে কাঠ-চেরাইয়ের মতো বিকট আওয়াজ তুলে হা হা করে হেসে উঠল। আর সেই হাসির আওয়াজে রঘুর সামনে বিশ্বসংসার লুপ্ত হয়ে গেল।
যখন জ্ঞান হল, তখন রঘুর মাথার ভেতরটা ঠিক চরকির মতো ঘুরছে। কিছুক্ষণ ধরে একরাশ সর্ষের ফুলের মতো কী কতগুলো তার সামনে নাচতে থাকল, মনে হল, একটা মাকড়সার জাল হাওয়ায় দুলছে আর তার ভেতর থেকে কয়েক জোড়া পাকানো চোখ কটকট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
রঘু উঠে বসল।
একটা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে সে পড়ে ছিল এতক্ষণ। দেখল, কেমন করে যেন একটা পুরনো পোড়ো বাড়িতে এসে পড়েছে সে। সামনে একটা জানালা দিয়ে রোদ আসছে, সেই রোদ পড়ে একটা মাকড়সার জাল জ্বলজ্বল করছে, তার মধ্যে মস্ত কালো মাকড়সাটা কদাকার পা নেড়ে চলে বেড়াচ্ছে। ইট-বেরকরা দেওয়ালগুলোতে কোথাও চুনের আস্তর নেই–একটা ভ্যাপসা ভিজে গন্ধ উঠছে, হাওয়ার ধাক্কায় জানলার আধভাঙা পাল্লা ক্যাঁচ ক্যাচ করে শব্দ তুলছে। ঘরটা বেশ বড়। তারই একটা দিকে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে আছে। সে। একটু দূরে গোটাতিনেক খাঁটিয়ার ওপর ময়লা বিছানা গোটানো রয়েছে, লোটা আছে গোটা চারেক, দেওয়ালে হেলান দেওয়ানো রয়েছে মোটামোটা বাঁশের লাঠি আর সড়কি বল্লম। দুটো দরজা–একটা সামনের দেওয়ালের গায়ে, সেটা বন্ধ আছে। বোধহয় পাশের ঘরের দরজা। আর একটা দরজা তার ডানদিকে, সেটা ভোলা,-জানালা দিয়ে বাতাস এসে সেই পথে হু-হুঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। গাছপালার শব্দ আসছে, শোনা যাচ্ছে পাখির ডাক।