একটা দমকা হাওয়া এল সেই সময়। বোধহয় ভগবানই পাঠালেন।
–আরে হাঁ-হাঁ-হাঁ—
চম্পতিয়া চেপে ধরবার আগেই তার কাঁধের গামছাটা হাত-দশেক উড়ে গেল। আর চম্পতিয়া ছুটল সেই পলাতক গামছার সন্ধানে। নাউ অর নেভার–ক্লাস এইটে তিন বছর আটকে থাকা রঘুর এই ইংরেজী বচনটা জানা। সঙ্গে সঙ্গেই সে এগিয়ে গেল থালাটার দিকে, মালগাড়ির তলা থেকে হাত বাড়াল তারপর সেই আধসের ছাতুর তাল পেতলের থালাটা থেকে অদৃশ্য হল। বিলীন হল চোখের পলকেই।
গামছা কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে এসেই মুখ হাঁ হল চম্পতিয়ার।
–আরে ই ক্যা হো? ছাতুয়া কিধর গৈল বানু? কুত্তা লে গৈল ক্যা?
কিন্তু কাছাকাছি কোনও কুকুরের চিহ্ন পাওয়া গেল না। আর চোখের দৃষ্টি কম বলেই চস্পতিয়া দেখতে পেল না, রাঘবলাল ততক্ষণে সেই ছাতুর তাল নিয়ে পেছনের একটা মালগাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
–রাম রাম! ইয়ে তো জিন মালুম হোতা। ব্যস—চম্পতিয়া আর দাঁড়াল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল স্টেশনের দিকে।
আর তখন আধখোলা বিচালিতে অর্ধেক-বোঝাই একটা মালগাড়িতে চেপে বসেছে রাঘবলাল। আর বিচালির মধ্যে লুকিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে ছাতুর তালটা সে সাবাড় করছে।
যাক–এতক্ষণে পেটটা একটু ঠাণ্ডা হল।
পেট কেবল ঠাণ্ডাই হল না, পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠল। রঘু আর বসতে পারল না–বিচালির মধ্যেই দিব্যি আরাম করে শুয়ে পড়ল। আস্তে-আস্তে ঘুমে জড়িয়ে এল চোখ।
আবার যখন ঘুম ভাঙল–
মনে হল, স্বপ্ন দেখছে। হু-হুঁ করে হাওয়া লাগছে গায়ে, কালো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটা ছুটন্ত ট্রেনের ভোলা গাড়িতে সে কাত হয়ে শুয়ে আছে। দু-পাশে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে অন্ধকার বন জঙ্গল, মাথার ওপর রাশি রাশি তারার দিকে ইঞ্জিনটা মুঠো মুঠো আগুনের ফুলকি ছুঁড়ে দিচ্ছে, ঝড়াং ঝড়াং করে বিকট আওয়াজ উঠছে ট্রেনের লোহা-লক্কড়ে আর–
আর কে যেন একটা কড়কড়ে লম্বা জিভ দিয়ে এক মনে তার পিঠটা চেটে চলেছে।
.
তিন
আতঙ্কে হাউ-মাউ করে উঠল রাঘব। কালো অন্ধকারে ছিটকে চলেছে বন-জঙ্গল, হাওয়ায় উড়ছে অসংখ্য আগুনের ফুলকি, শব্দ হচ্ছে ঝড়াং ঝং ঝনাৎ ঝনাৎ। এ যেন ট্রেনের আওয়াজ! রঘু কি তবে রেলগাড়িতে বসে আছে নাকি? আর বসে আছে একটা খোলা কামরায়–বাতাস তাকে যখন খুশি উড়িয়ে নিতে পারে?
এ কী সর্বনাশ! রাঘব কি স্বপ্ন দেখছে নাকি?
কোথায় তাদের বাড়ি–দোতলার ঘরের নরম বিছানাটি। মা যে পরিপাটি করে মশারি খুঁজে দেন, কোনও কোনও দিন মাথায় হাত দিয়ে ঘুম পাড়ান, গরম লাগলে পাখার বাতাস করেন। তার বদলে এ কী কাণ্ড! জিন-পরীর খেল নাকি? তখন সব মনে পড়ল। সেই কালান্তক ছানার জিলিপি, রামগর্জনের হাতের সেই রামলাঠি, মালগাড়ির তলায় লুকিয়ে থাকা, চম্পতিয়ার ছাতুর তাল লোপাট করা। আর তারপর–ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেই ফাঁকে মালগাড়িটা টেনে নিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে? কাশী–কনৌজ—এলাহাবাদ–কলকাতা যেখানে খুশি চলে যেতে পারে এ-গাড়ি। তখন কী করবে রাঘব? বাবা নেই, মা নেই, বাবার দোকানের মেঠাই নেই–একেবারে যে বেঘোরে মারা যাবে রাঘবলাল!
আমায় মাপ করো বাবা, আর কোনওদিন আমি চুরি করে খাব না রঘু ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। আর ঠিক তখন তার কানের কাছে ভোঁস ভোঁস করে কে যেন গরম গরম নিঃশ্বাস ফেলল–আর লম্বা একটা খরখরে জিভ দিয়ে চকাত চকাত করে ঘাড়ের উপর চেটে দিলে।
–ওরে বাবা। পেত্নীতে চেটে চেটে রক্ত খাচ্ছে নাকি? রাঘবলাল চেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল আর সেই সময় ট্রেন ঝড়াং ঝাং করে একটা বাঁক নিতেই আবার উল্টে পড়ল সেই গাদা করা খড়ের ভেতর।
আর পড়েই দেখতে পেলে—
পেত্নী নয়–আট-দশটা গোরু। এতক্ষণে রাঘবলাল বুঝল, নেহাত একটা গোরুর মতোই সে গোরুদের গাড়িতে উঠে পডেছে–এই বিচালিগুলো তাদেরই খাদ্য। আর বিচালির মধ্যে রাঘবলাল আবিষ্কার করে অপত্য স্নেহে তারা তার গা চেটে দিচ্ছে।
হায় ভগবান, এ কী ল্যাঠা!
রাঘবলাল একটু সরে বসল। বেশি দূর সরতে ভরসা হয় না–তা হলে সোজা গাড়ি থেকে একেবারে চাকার তলায়। তার ওপর যা হাওয়া! আশ্বিনের রাত–দস্তুরমতো শীত করছে তার। গায়ে একটা গেঞ্জি ছাড়া কিছুই নেই। রাঘব কোঁচার খুট জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল বিচালির ভেতর।
কিন্তু পৃথিবীর সব জিনিসকে ঠেকানো যায়–একমাত্র গোরুকে ছাড়া। গোরা যে কী ভয়ানক দুরন্ত আর দুর্ধর্ষ হতে পারে, রাঘব তা আগেও অনেকবার দেখেছে। একবার বাজারে ঢুকে পড়েছে তো এক খাবলায় এক ঝুড়ি লাউডগা মুখে তুলে নেবে, দোকানে গলা বাড়িয়ে চালে ডালে যাতে যাতেই মুখ দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে সের-তিনেক সাফ! যতই লাঠিপেটা করো, চোখ বুজে ঠায় চিবুতে থাকবে–যেন বিয়েবাড়ির ভোজ পেয়ে পরম আরামে নেমন্তন্ন খাচ্ছে। আর যখন শিং নেড়ে তাড়া করে আসে তখন তো কথাই নেই কাউকে না কাউকে গুঁতিয়ে তবে তার গোঁ থামবে। এই গোঁয়ের জন্যেই বোধহয় গোরুকে গো বলা হয়ে থাকে।
সুতরাং রাঘবও পালাতে পারল না।
একটা বড় বড় শিংওলা গোরু সমানে তার কান চাটতে লাগল। রাঘব দু-একবার ভাঙা গলায় বললে, হেই-হেই। জোরে বলতে সাহস হল না, পাছে এক গুতোয় তাকে সোজা গাড়ির তলায় ফেলে দেয়।
অবশ্য তাকে তোবার রাইট গোরুদের আছে–ষোলো আনাই আছে। কারণ মানুষের রিজার্ভ কামরার মতো এ-গাড়িও গোরুদের রিজার্ভ করা। রাঘবলাল নিতান্তই অনধিকার প্রবেশ করেছে এখানে। তারা যদি হটো-হটো রিজার্ভ যায়, দুসরা ডিব্বামে চলা যাও-বলে চাঁদা করে তাকে গুতিয়ে দেয়, তা হলে সে তো আর কোথাও নেই। তার ওপর। রাঘবলাল স্রেফ বিনা টিকিটের যাত্রী। সুতরাং গোরুকে কর্ণগোচর করে, অর্থাৎ কর্ণে গোরুকে চরতে দিয়ে সে ঝিম মেরে বসে রইল।