না হয় খেয়েইছে ডজন-দুই ছানার জিলিপি। পরের তোতা নয়, বাপের দোকানেরই তো জিনিস। তারই জন্যে এত লাঞ্ছনা? বাপ রামগর্জনের এমনি রামগর্জন? আর এই পিলে-চমকানো পেল্লায় কোঁতকা নিয়ে তাড়া করা? তার গোলগাল ভালোমানুষ চেহারার বাপের প্রাণ যে এমন পাষাণের মতো কঠিন–সে কথা কে কবে চিন্তা করেছিল!
কিন্তু আপাতত রঘুকেই চিন্তা করতে হচ্ছে। আর সেটা চলছে স্টেশনের সাইডিঙে একটা মালগাড়ির তলায় ঘাপটি মেরে বসে। বাপের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার জন্য আপাতত এ-ছাড়া ভালো জায়গা আর সে খুঁজে পায়নি।
সেই পালিয়ে এসেছে সকালবেলা, এখন রোদ হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। এর মধ্যে। বার-পাঁচেক খাওয়া হয়ে যায়, কিন্তু রঘুর মুখে এক ফোঁটা জল পড়েনি। একে পেটুক মানুষ, তায় দারুণ খিদে পেয়েছে–পেটের নাড়িগুলো ত্রাহি ত্রাহি করে ডাক ছাড়ছে। কিন্তু রঘুর বেরুবার সাহস নেই। স্টেশনের সবাই তাকে চেনে, এতক্ষণে তার খোঁজও পড়েছে নিশ্চয়। বেরুলেই কেউ না কেউ ক্যাঁক করে গলাটা পাকড়ে বাপের কাছে নিয়ে যাবে তাকে। আর তারপর–তারপর–সেই লাঠি! রামলাঠি!
না, রঘু যাবে না। তারও মনে দারুণ ধিক্কার এসে গেছে। ছি-ছি, কয়েকটা ছানার জিলিপির জন্যে কেন এত লাঞ্ছনা! ভাই নেই, বোন নেই–একমাত্র ছেলে সে, তার সঙ্গে এমন নৃশংস ব্যবহার! বেশ, সেও আর বাড়ি ফিরবে না। কলকাতায় চলে যাবে, সেখানে রোজগার করবে, তারপর সেও একটা মিঠাইয়ের দোকান দেবে। যত ইচ্ছে খাবে, যা খুশি বিক্রি করবে। তখন হায় হায় করতে থাকবেন রামগর্জন, বুঝবেন রাঘবলালও নেহাত তুচ্ছ করবার ছেলে নয়।
রঘু সেই মালগাড়ির তলায় বসে সারা দুপুর এইসব কঠিন প্রতিজ্ঞা করছিল আর দেখছিল একটু দূরে পাথরের ভেতর থেকে ড্যাবডেবে চোখ মেলে একটা কটকটে ব্যাঙ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকটা ঢিল মেরে ব্যাঙটাকে তাড়িয়ে দিয়ে রঘুর মনটা শান্ত হল। তারপর গাড়ির তলায় ঠাণ্ডা ছায়ায় বেশ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। এলোমেলো ভাবনায় দুপুর গড়িয়ে গেল, সামনে দিয়ে কুলি আর পয়েন্টসম্যানরা আসা-যাওয়া করল, ঝমঝম করে অনেকগুলি ট্রেন এল আর গেল! তারপরেই দেখা দিল প্রচণ্ড খিদে।
কলকাতায় যাওয়ার প্রতিজ্ঞা বুঝি আর টেকে না; মা-র কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে। ধোঁয়ানো গরম ভাতের ওপর খাঁটি ঘিয়ের গন্ধ, ঘন অড়হড়ের ডাল, ভাজা-ভুজি, আলুর দম, চাটনি, ক্ষীরের বাটি–তার সঙ্গে চারটি টাটকা মিষ্টি। বুকের ভেতর আঁকুপাঁকু করে, পেটটা চোঁ চোঁ করতে থাকে। রঘু ভাবে, বাবার রাগ নিশ্চয় এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, মা বসে বসে। তার জন্যে চোখের জল ফেলছেন। বেরুবে? দেখবে নাকি একটুখানি এগিয়ে?
কিন্তু–বাবার হাতের সেই লাঠি! সেই বাঘা হুঙ্কার! সে-যাত্ৰা নয় ষাঁড়ের লড়াইয়ের জন্যে প্রাণ বেঁচেছে, কিন্তু এবার যদি বাবা টিকিটা একবার চেপে ধরতে পারে–
ভাবতেই প্রাণ শুকিয়ে এল।
এদিকে কী খিদেই যে পেয়েছে। সেই কটকটে ব্যাঙটাকে ধরতে পারলেও চিবিয়ে খায় এমন মনের অবস্থা! আর তো সহ্য করা যায় না!
বাইরে রোদ লাল হয়ে এসেছে–রঘুর চোখের সামনে সার বাঁধা রেললাইনের ওপর দিয়ে লম্বা লম্বা ছায়া নামছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। তারপর রাত আটটার সময় কলকাতা যাওয়ার গাড়িটা এলে টুক করে বেরিয়ে রঘু চেপে বসবে তাতে। কিংবা রঘু ভাবতে লাগল, সেই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকেও এগোনো যেতে পারে। খিড়কির দরজা দিয়ে যদি একবার ভেতরে ঢোকা যায়, একবার যদি মার আঁচলের তলায় আশ্রয় নেওয়া যা,–তা হলে—
কিন্তু তারও তো দেরি আছে। এতক্ষণ থাকা যায় কী করে? রঘু কি এই মারাত্মক খিদেতেই মারা পড়বে নাকি শেষপর্যন্ত।
যা হওয়ার হোক–বাড়ির দিকেই যাই–এমনি একটা প্রায় ঠিক করে ফেলেছিল রঘু। ঠিক সেই সময়
যে-মালগাড়ির তলায় সে শুয়েছিল, তার থেকে হাত চারেক দূরে দুটো লম্বা কালো পা দেখা গেল। একবারের জন্যে রঘুর বুক ধড়ফড় করে উঠল। বাবা নাকি? খোঁজ পেয়ে ধরতে এসেছে তাকে? পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে সটকান দিতে যাবে, এমন সময় পায়ের মালিক ঝুপ করে সেখানে বসে পড়ল। আর বেশ দরাজ গলায় গান ধরলে :
আরে ভজো ভেইয়া কৌশল্যানন্দনকো
ভজো সিয়া রামকো—
না–বাবা নয়। লোকটাকে রঘু চেনে। এই স্টেশনেরই বুড়ো কুলি চম্পতিয়া।
চম্পতিয়া তাকে দেখতে পায়নি বলেই মনে হল। মালগাড়ির তলায় কালো ছায়ার ভেতর লুকিয়ে থেকে লক্ষ করতে লাগল রাঘবলাল। তার আরও মনে পড়ল চম্পতিয়া ডান চোখে দেখতে পায় না। দিনের আলোতেই হাত চার-পাঁচের বেশি তার নজরে আসে না। সুতরাং রঘুকে সে যে দেখতে পাবে এমন সম্ভাবনা বিশেষ নেই।
আরে ভজো ভেইয়া রাবণসুদন,
ভজো রঘু রাইকো—
রঘু রাইকে ভজন না-হয় করুক, কিন্তু এখানে বসে বসে কী করছে চম্পতিয়া? এতক্ষণে সব দেখতে পেল রঘু। তাকেই ভজন করুক আর শ্রীরামচন্দ্রজীকেই করুক, সামনে যা করছে তা ভোজনের আয়োজন। একটা পেতলের থালায় ছাতু ঢেলেছে লোটা থেকে জল দিয়ে পাকাচ্ছে মস্ত এক গোলা। কাঁচা লঙ্কা আছে, লবণ আছে, দুটো বড় বড় কলাও রেখেছে। পাশে।
ছাতু অবশ্য রাঘবলালকে বিশেষ খেতে হয় না, কিন্তু চম্পতিয়ার খাওয়ার ব্যবস্থা দেখে তার জিভে জল এসে গেল! ইস্! ও-থেকে একটুখানি ছাতু যদি সে পেত। পেটের ভেতরে আগুন জ্বলছে, আর মাত্র হাত কয়েক দূরেই এমন জবরদস্ত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। কাঁচা লঙ্কা আর ছোলার ছাতুর গন্ধও এত মিষ্টি লাগে!