একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলতে মায়া হয় রামগর্জনের। তবু কান শক্ত করে ধরে কড়া মোচড় লাগিয়েছেন একটা।
–এতক্ষণ ধরে কী বোঝালুম–অ্যাঁ! গড্ডর কাঁহাকা–হতচ্ছাড়া পেটুকদাস।
–কী করব বড্ডে খিদে পেয়েছিল যে!
–খিদে! তোর হয়েছে সেই গাঁয়ের গোবকের দশা!বাপের মুখ থেকে শোনা একটা হিন্দী বচন আওড়ান রামগর্জন যে খায়–ও লালায়! বলি পেটে কী আছে? জালা না সিন্দুক?
রঘু জবাব দেয় না, ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে যেমন, তেমনি পরমহংস হয়েই বসে থাকে।
–এরপরে তুই আমাকে খাবি, বুঝেছিস? তুই তো রাঘব নোস–রাঘব বোয়াল! আমাকে খেয়েই তোর লালচ শান্ত হবে।
রঘু একবার বাপের দিকে তাকিয়ে দেখে। খুব সম্ভব ভাবে, তার বাবা যদি একটা প্রকাণ্ড পান্তুয়া হত, তা হলে এ-অনুরোধ করবার একেবারেই দরকার হত না। অনেক আগেই সে–
রামগর্জনবাবু কপাল থাবড়ে বললেন, বরাত, বরাত! নইলে এমন পেটুক এসেও মিঠাইওলার ঘরে জন্মায়!
আজও রামগর্জন দোকানে বসে নিজের দুঃখের কথাই চিন্তা করছিলেন। ছেলেটার এই খাই-খাই রোগ কী করে বন্ধ করা যায়? আর চুরি করে খাওয়া? ছানার সঙ্গে খানিকটা বাঘা ওল মিশিয়ে সন্দেশ খাইয়ে দেখবেন নাকি? উহুঁ, ওতে সুবিধে হবে না। যে রাক্ষস বাঘা ওল-টোল সব হয়তো অম্লান মুখে হজম করে বসবে। আর তা না হলে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হবে এবং তাঁকেই ছুটতে হবে।
.
একটু একটু করে সকাল হল। রাশি রাশি গরম গরম জিলিপি পড়ল রসের ভিতর, জমল কচুরি আর নিমকির ভূপ। বোঁদে চড়ল। দোকানে খদ্দেরের ভিড় শুরু হয়ে গেল।
মনটা শান্ত করে রামগর্জন পয়সা গুনতে আরম্ভ করলেন। আপাতত ছেলের চিন্তাটা ধামাচাপা পড়ল।
এমন সময় ভঁক ভঁক করে একখানা মোটর গাড়ি এসে থামল তাঁর দোকানের সামনে। নেমে এলেন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান গৌরহরিবাবু। গায়ে গরদের পাঞ্জাবি–গলায় সিল্কের চাঁদর। একখানা ঝানদার লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে দোকানে এসে ঢুকলেন।
রামগর্জন দাঁড়িয়ে উঠলেন : আসুন স্যার আসুন! বসুন।
গৌরহরি বললেন, বসবার সময় নেই। আমার মেয়ে-জামাই এসেছে সাড়ে ছটার ট্রেনে, গাড়িতে বসে আছে তারা। তোমাকে যে আড়াই সের স্পেশ্যাল ছানার জিলিপি তৈরি করতে বলেছিলুম, সেটা–
–হ্যাঁ স্যার কাল রাতেই রেডি করে রেখেছি। দিচ্ছি এখুনি।
স্পেশ্যাল অর্ডারের আলমারিটা খুললেন রামগর্জন!
এর চাবি তাঁর ঘুনসিতেই থাকে।
কিন্তু খুলে যা দেখলেন–তাতে তাঁরই চোখ ছানাবড়া নয়, একেবারে ছানার জিলিপি হয়ে গেল।
অত বড় হাঁড়িটা প্রায় সাফ। তলায় খানতিনেক পড়ে আছে ধ্বংসাবশেষের মতো!
–কী হল হে?
তিনটে খাবি খেয়ে রামগর্জন বললেন, আপনি যান স্যার একটু পরেই আমি তোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
গৌরহরি চলে গেলেন। আর সেইখানে কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন রামগর্জন। ব্যাপারটা চক্ষের নিমেষে বুঝতে পেরেছেন। কাল রাত্রে যখন ঘুমিয়েছেন, তখন তাঁর কোমর থেকে চাবি খুলে এনে বন্ধ দোকানের ভেতরে বসে নিঃশব্দে ওগুলো সাবাড় করেছে রঘু। রাতের বেলা ছানার জিলিপির পাশে সে অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরঘুর করছিল বটে।
অনেক হয়েছে–আর নয়। আর ছেলেকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। এইবার একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।
দোকানের পেছনেই বাড়ি। একলাফে বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন। কুড়িয়ে নিলেন একটা বাঁশের লাঠি। এতদিন পরে সত্যিকারের রামগর্জন ছাড়লেন একখানা।
–কোথায় রঘুয়া? কোথায় সেই রাক্ষস–সে রাঘববোয়াল? আমি আজ ওকে খুন করব–জরুর উসকো জান লে লেগা!
রামগর্জনের স্ত্রী ছুটে এলেন। ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া?
–হুয়া আমার মাথামুণ্ডু! আজ তোমার ছেলের ভুড়ি ফাঁসিয়ে না দিই তো আমি রামগর্জন সিং-ই না। কোথায় সেই বদমাস–বেল্লিক পেটুকদাস।
গৌরহরিবাবুর মোটর দোকানের সামনে থামতে দেখেই দু-একটা কিল-থাপ্পড়ের জন্য তৈরি হচ্ছিল রাঘবলাল। কিন্তু বাপের এই রুদ্রমূর্তি সে কল্পনাও করেনি। অতএব বাপের লাঠি ঘাড়ে পড়বার আগেই যঃ পলায়তে সঃ জীবতি! তড়াক করে সে বড় রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল, তারপর টেনে দৌড়।
–কাঁহা ভাগবি? আজ তোমার মুণ্ডু ছাতু করে তবে আমি বলে রামগর্জন ছেলেকে তাড়া করলেন। প্রায় ধরেই ফেলেছেন এবং লাঠির একটা ঘা বসিয়ে দিতে যাচ্ছেন ছেলের পিঠে–এমন সময় কোত্থেকে দুটো ষাঁড় গুঁতোগুতি করতে করতে দুজনের মাঝখানে এসে পড়ল। রামগর্জন থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, আর
আর এক জোড়া যুযুৎসু ষাঁড়ের ভেতর দিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, রঘুর মাথার টিকিটি বাতাসে নাচতে নাচতে অনেক দূরে মিলিয়ে গেল–মিলিয়ে গেল তাঁর লাঠির আওতার বাইরে–অনেক দূরে।
.
দুই
ইস্ কয়েকটা ছানার জিলিপির লোভে শেষ পর্যন্ত কী ল্যাঠাতেই পড়া গেল। বাবা যে এমন খেপে যাবে সেকথা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল রঘু!
চিরকালই সে আদুরে ছেলে। চড়-চাপড় কখনও সখনও দুটো-চারটে না খেয়েছে তা নয়, মিঠাই খেয়েছে অনেক বেশি। ছানার জিলিপি খাওয়ার সময় জানত দু-এক ঘা পিঠে পড়বেই, আর পিঠে এক-আধটু না সইলে পেটের তোয়াজই বা করা যায় কী করে?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাঠি! আর ওই রকম গাঁটেগাঁটে পাকানো রাম-লাঠি! ওর এক-এক ঘা জুত-মতো পড়লেই আর দেখতে হবে না, রঘু স্রেফ ছাতুনা না, হালুয়া হয়ে যাবে! হালুয়া খেতে ভালোই কিন্তু হালুয়া হওয়া যে মোটেই ভালো নয়, এটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধি রঘুর আছে।