গাছটার দিকে তাকিয়েই আজ যেন গা ছমছম করে উঠল। ওর তলা দিয়েই মেটে রাস্তাটা চলে গেছে সুন্দরপুর পর্যন্ত। আশেপাশে আর জনমানুষের বসতি নেই। ওই পথ। দিয়েই কালো হাতখানা গেছে। কোথায়? সুন্দরপুরের নিতাই সরকারের বাড়িতে।
গণেশবাবুর মাথাটা আবার ঝিমঝিম করতে লাগল। স্টেশনের ওপাশে মালগুদাম, তার নীচে দিয়ে বন জঙ্গল ঢালু হয়ে নেমে গেছে কাদায় আর গোখরো সাপে ভরা এলোমেলো বিল আর বুনো ঘাসের একটা উচ্চুঙ্খল জগৎ। মাঝে মাঝে পেত্নীর মতো তেঠেঙে চেহারার শ্যাওড়া গাছের সারি। ওখানে–ওই জলার জঙ্গলে কী যে নেই, এক ভগবানই বোধকরি সে কথা বলতে পারেন; শেয়াল আছে, বুনো শুয়োর আছে, শোনা যায় বাঘও আছে। আর হয়তো দলে দলে মামদো আছে, স্কন্ধকাটা আছে যারা খুশিমতো এক-একখানা কালো হাত বাড়িয়ে–
গণেশবাবু আর ভাবতে পারলেন না।
বাঁকের মুখে আচমকা একটা তীক্ষ্ণ রেলের বাঁশি। গণেশবাবু হঠাৎ চমকে উঠলেন। ঝরাং ঝরাং ঝিপ ঝিপ শব্দ করতে করতে একখানা গাড়ি এসে স্টেশনে ভিড়ল। ওদিকে আর-একটা হুইসেল। আর একখানা ট্রেনও এসে পড়ল বলে।
গণেশবাবু জোর পা চালিয়ে দিলেন।
.
স্টেশনে ঢুকতেই গিরিধারীর সঙ্গে দেখা।
–মাস্টারবাবু, দুজন লোক আপনাকে খুঁজছে।
–আমাকে? গণেশবাবু ভু কঁচকোলেন।–কারা রে?
–তা তো জানি না। দুজন ভদ্রলোক।
–ভদ্রলোক! সেকি! কোথায়?
–ওয়েটিং রুমে বসে আছে। ডাউন গাড়ি থেকে নেমেছে।
গণেশবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। মনটা চিন্তায় ভরে উঠেছে মূহুর্তে। এই অজগর জঙ্গলে কারা তাঁকে খুঁজতে এল? এমন আত্মীয়ই বা তাঁর কে আছে? কলকাতা থেকে আত্মীয়স্বজন যদি কেউ খুঁজতে এসে থাকে তারাই বা চিঠিপত্র না দিয়ে এমন করে চলে আসবে কেন? আর যদি বা এসেও থাকে তা হলে সোজা তাঁর কোয়ার্টারেই তো চলে যেতে পারে–এখানে বসে থাকবে কোন্ দুঃখে?
সাত-পাঁচ ভেবে গণেশবাবু ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন।
নামেই ওয়েটিং রুম। একটা পুরনো ওভ্যাল-শেপ কাঠের টেবিল, তার ওপরে আধ ইঞ্চি ধুলো জমে আছে। একটা ডেক-চেয়ার আছে বছর ত্রিশেক আগেকার, তার বেতের ছাউনি বারো আনার মত খসে পড়ে গেছে। আর একটা বেঞ্চি আছে একপাশেদরকার হলে সেখানে পড়ে পড়ে গিরিধারী নাক ডাকায়।
দুটি যুবক সেখানে বসে সিগারেট টানছিল। গণেশবাবু ঘরে ঢুকতেই তারা উঠে দাঁড়াল, তারপর নমস্কার করলে। গণেশবাবুও প্রতি-নমস্কার জানালেন।
একজন সাহেবি পোশাক পরা, চোখে সোনার চশমা। বেশ প্রিয়দর্শন চেহারা চোখে তীক্ষ্ণধার বুদ্ধির আলো। সেই ই আলাপ আরম্ভ করলে।
–আপনি গণেশবাবু?
গণেশবাবু সবিনয়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
–এখানকার স্টেশনের ইনচার্জ বুঝি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনারা?
–বলছি।–সাহেবি পোশাক পরা যুবকটি বললে, বসুন না। সিগারেট নিন। আপনার সঙ্গে একটু জরুরি ব্যাপার আছে।
জরুরি ব্যাপার! গণেশবাবুর বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। এরা কারা? এইরকম একটা জংলি স্টেশনে দুটি বিশিষ্ট লোকের হঠাৎ আসবার হেতুই বা কী? কেমন যেন সন্দেহে গণেশবাবুর মাথাটা ঘুরতে লাগল।
গণেশবাবু বেঞ্চিটার ওপরে বসলেন। দ্বিধাভরে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা আসছেন কোত্থেকে?
এবার জবাব দিলে দ্বিতীয় যুবকটি। এ সাহেবি পোশাক পরা নয়, কিন্তু এরও বেশবাসে যথেষ্ট পারিপাট্য আছে। তা ছাড়া এ-লোকটির একটা একটা বিশেষত্বও এতক্ষণে গণেশের চোখে পড়ল। মস্ত জোয়ান। পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবির নীচে তার শরীরের লোহার মত মাগুলো ফুলে ফুলে উঠেছে। মাথার চুলগুলো কড়া, তামাটে। গাল দুটো ভাঙা, চোয়ালের হাড় খগের মতো খাড়া হয়ে আছে। মুখের হাঁকড়াটা যেন একটু বেশি বড় সব মিলিয়ে যেন একটা ভয়ানক চেহারার বুলডগের আদল আসে। প্রথম লোকটির চাইতে এর বয়সও একটু বেশি মনে হল।
গম্ভীর গমগমে গলায় সে বললে, কলকাতা।
–কলকাতা? তা এখানে কী কাজে? কোথায় যাবেন?
–দাঁড়ান, ব্যস্ত হবেন না-দ্বিতীয় লোকটি সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বেশ রহস্যমণ্ডিত হাসি হাসল; কাছাকাছি কোথাও ডাকবাংলা আছে বলতে পারেন?
–আছে, সুন্দরপুরে। মাইল পাঁচেক দূরে হবে।
–সুন্দরপুর! নতুন লোক দুটি যেন একসঙ্গে চমকে উঠল। সাহেবি পোশাক পরা যুবকটি সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খানিকক্ষণ অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। বললে, না, সেখানে চলবে না। এই ওয়েটিং রুমেই আমরা দিনকয়েক কাটাতে চাই। কী বলেন গণেশবাবু?
গণেশবাবু বিব্রত হয়ে বললেন, তা কেমন করে হবে? রেল কোম্পানির আইন আছে তো একটা। থাকতে দেবে কেন?
দ্বিতীয় লোকটি সশব্দে হেসে উঠল। বাইরে ট্রেন দুটো অনেকক্ষণ আগেই স্টেশন ছাড়িয়ে চলে গেছে, দুপুরের রোদে ঝাঁ ঝাঁ করছে নির্জনতা। তার হাসির শব্দে চারিদিকে স্তব্ধতা যেন দুলে উঠল।
–আইন আপনাকে কিছু বলবে না। আমরাও আইনের তাগিদেই এসেছি।
পুলিশের লোক আমরা ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ।
গণেশবাবু সভয়ে উঠে দাঁড়ালেন। –অ্যাঁ–তাই নাকি। মাপ করবেন, বুঝতে পারিনি। কিছু মনে করবেন না, স্যার।
প্রথম যুকটি বললে, না না, মনে করব কেন। আপনাকে আমাদের চাই, একটা অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপারে আপনি আমাদের হেলপ করবেন। একটা সাসপেক্টেড খুন, প্রচুর টাকা চুরি এবং তার সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক গণ্ডগোল–সব মিলিয়ে জিনিসটা পুলিশ বিভাগে মস্ত একটা গোলকধাঁধা হয়ে আছে। আপনি আমাদের সাহায্য করবেন নিশ্চয়ই?