বিদ্যুতের চমক খাওয়ার মতো করে নিতাইয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে গেল।
–আমায় এখানে তুমি আশা করোনি–না?
নিতাইয়ের ঠোঁট দুটো একবার নড়ে উঠল। কিছু বলতে চেষ্টা করল।
–কিন্তু আশা না করলেও অযাচিতভাবেই দেখা দিতে এসেছি। এতদিনের এমন নিবিড় বন্ধুত্ব–মায়া কাটানো কি এতই সহজ? উৎসবে, ব্যসনে, শ্মশানেসব জায়গাতেই বন্ধুর কাছাকাছিই থাকা উচিত–কী বলো?
কে বলবে? বলবার মতো অবস্থা নিতাই তখন হারিয়েছে। তার সমস্ত চেতনা যেন লুপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
–ভেবেছিলে, পালাবে? পালিয়ে বাঁচবে তিনশো মাইল দূরের এই পাড়াগাঁয়ে? কিন্তু অত সহজেই কি আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়? আমার জন্যে যা তুমি করেছ, সে-ঋণ শোধ করবার জন্যে দরকার হলে তোমাকে খুঁজতে আমি নরকে পর্যন্ত যেতে রাজি ছিলাম, বন্ধু। এই সুন্দরপুর আর কতটুকুই বা রাস্তা সে তুলনায়?
নিতাইয়ের একটা হাত নড়তে লাগল। বন্দুকটা ধরবার অন্তিম চেষ্টা করল যেন। কিন্তু আলখাল্লার ফাঁকে দুটো চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সে ক্রমেই সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে। শরীরের একটি স্নায়ুপেশীও তার বশে নেই।
শ্ৰীমন্ত রায় বললে, শোনো। আমার পাওনাগণ্ডা এই মুহূর্তে মিটিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করব না। অপ্রস্তুত অবস্থায় শোধ নেওয়াটা তোমাদের মতো কাপুরুষের ধর্ম হতে পারে, কিন্তু তা আমার নয়। তিন দিন সময় আমি তোমাকে দিলাম। অনুতাপের যা-কিছু সুযোগ এর মধ্যেই তুমি পাবে। তারপর আমি আবার আসব। সেদিন, জেনে রেখো, আমার হাত থেকে কিছুতেই তোমার পরিত্রাণ নেই।
বাইরে আবার হাওয়া গোঁ-গোঁ করে উঠল। গোঙিয়ে উঠল বকের ছানারা। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ জানলার কাছে সরে এল শ্ৰীমন্ত রায়। অসাড় চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতাই দেখতে পেল, খোলা জানলা দিয়ে বিদ্বেগে শ্ৰীমন্ত হারিয়ে গেল অন্ধকারে, শুধু অনেক নীচে ধুপ করে শব্দ হল।
কড় কড় করে বাজ ডেকে গেল আকাশে। চোখ ধাঁধিয়ে গেল একরাশ অতি তীব্র বিদ্যুতের আলোয়। সেই আলোয় নিতাই দেখলে, অমানুষিক শক্তির সাহায্যে লোহার শক্ত গরাদ দুধারে বাঁকিয়ে দিয়ে তার ভেতর দিয়ে কেউ ঘরে ঢোকবার পথ করে নিয়েছে।
প্রায় দশ মিনিট পরে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল নিতাই। হাত বাড়িয়ে চড়িয়ে দিল লণ্ঠনের আলো।
.
তিন
সকালে স্টেশনে কাজ ছিল না। নাইট-ডিউটির পরে বেলা বারোটা পর্যন্ত কোয়ার্টারে টানা ঘুম লাগালেন গণেশবাবু। কিন্তু নিশ্চিন্ত নিদ্রা নয়–থেকে থেকে কেমন একটা দুঃস্বপ্নে যেন তিনি আঁতকে উঠছিলেন। অন্ধকার অমাবস্যার রাত–প্ল্যাটফর্মে মিটমিটে আলোয় দরজার হাতলের ওপরে একখানা হাত এসে জেঁকে বসেছে বাঘের থাবার মতো। রোমশকর্কশ–ভয়ঙ্কর।
একখানা কালো হাত। পৃথিবীর যত হিংসা আর বিভীষিকা যেন সেই হাতে। যেন সামনে যাকে পাবে, তারই গলা টিপে ধরবে।
বেলা বারোটার সময়ে এই অস্বস্তিকর ঘুম থেকে গণেশবাবু উঠে বসলেন। হাত-মুখ ধুয়ে পুরো দুপেয়ালা চা আর চারটে ডিম খেয়ে প্রাতরাশ করলেন। মোটা মানুষ, বেশ খেতে পারেন–খেতে ভালোও বাসেন। আর লোভের জন্যেই না তাঁর এই দুর্গতি। দিব্যি ছিলেন শিয়ালদা স্টেশনে, কী কুক্ষণেই যে হতভাগা গোমেজের পাল্লায় পড়ে প্রফেসার ভাদুড়ীমশায়ের ল্যাংড়া আমেই তাঁর নজর গেল–
কিন্তু রাত্রে তিনি ও কী দেখলেন। স্বপ্ন, না সত্যি? গণেশবাবু ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা তো তাঁর অভ্যেস নয়। গাঁজা তিনি খান না–কোনও ভদ্রলোকেই খায় না। অল্প বয়সে দেশের বাড়িতে বিজয়া দশমীর দিন একবার সিদ্ধি খেয়েছিলেন। সিদ্ধির লোভে নয়–এক-এক গ্লাস সিদ্ধির সঙ্গে দুটো করে নাটোরের রসগোল্লা বরাদ্দ ছিল। তারই আকর্ষণে গাস-তিনেক সিদ্ধি টেনে যে-দুর্গতি তাঁর হয়েছিল সেকথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। দুদিন বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলেন, আর স্বপ্ন দেখেছিলেন–একটা পাটকিলে রঙের মস্ত রামছাগল শিং নেড়ে তীর হুঁড়িতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। দুদিন ধরে এমনি ভয়ঙ্করভাবে তিনি হেসেছিলেন যে তারপরে এক হপ্তা তিনি ভাত পর্যন্ত খেতে পারেননি–এত ব্যথা হয়েছিল চোয়ালে।
কাল রাত্রে তিনি তো সিদ্ধি খাননি। তবে কী ব্যাপার। গণেশবাবু বারকয়েক মাথা ঝাঁকড়ালেন। নাঃ–স্বপ্নই বটে। এমন ব্যাপার কখনও সত্যি হতে পারে। সত্যি হওয়া অসম্ভব। মিছিমিছি ও নিয়ে তিনি আর মাথা ঘামাবেন না। দেওয়াল-ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বেজেছে। পৌনে একটায় দুখানা গাড়ির ক্রসিং হয় মানিকপুরে। একবার স্টেশনে যাওয়া দরকার।
কোম্পানির নাম-লেখা চাঁদির-বোতাম-আঁটা শাদা জিনের কোটটা গায়ে চড়ালেন গণেশবাবু। তারপর চটিটা পায়ে দিয়ে গজেন্দ্রগমনে এগিয়ে চললেন স্টেশনের দিকে। স্টেশনের পাশেই সিগন্যাল নেমে পড়েছে–ট্রেনের আর দেরি নেই।
স্টেশনের পেছন দিয়েই একটা মেটে পথ। তার দুধারে উঁচু-উঁচু টিলা ডানদিকে একটি ঝুরি-নামা বটগাছ ছায়ার অন্ধকার করে চিত্রগুপ্তের মতো দাঁড়িয়ে। কোন্ আদ্যিকালের গাছ–তার বয়েসের যেন ঠিক-ঠিকানা নেই। সেই গাছের নীচে সিঁদুর-লেপা একটা থান। হাত-পা-ভাঙা কালো কষ্টিপাথরের একটা মুর্তি। কার্তিকী অমাবস্যায় দূর দূর গ্রাম থেকে লোক এসে রঙ্কিণী কালীকে পুজো করে যায়।