এ হেন ভয়ঙ্কর কলকাতার পথঘাট কি সোনা দিয়ে মোড়া? সেখানে কি টাকা-পয়সা এমন করে ছড়িয়ে রেখেছে যে ইচ্ছে করলেই মুঠোভরা কুড়িয়ে আনা যায়? কে জানে। নিতাই সরকারকে দু-একজন হাবেভাবে কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল। কিন্তু নিতাই একেবারে গাঁক গাঁক করে তেড়ে এসেছে।
–ওসব বাজে কথা আলোচনা করতে এসো না আমার কাছে। নিজেদের কাজকর্ম না থাকে, তারুমুদির দোকানে গিয়ে তামাক টানো গে।
লোকে তাই মনে মনে বিলক্ষণ চটে আছে নিতাইয়ের ওপর। আড়ালে-আবডালে নানারকম সমালোচনা করে।
–ইস্-তেজটা দ্যাখো না একবার!
–সেদিনের নেতাই ছোকা ন্যাড়া মাথা, পেটে পিলে! এক পো জিনিস মাপতে আধছটাক ওজনে ফাঁকি দিত–সে একেবারে লাটসায়েব হয়ে উঠেছে।
কান থেকে বিড়ি নামিয়ে সেটা ধরাতে ধরাতে একজন বলে, ও আর কিছু নয় বুঝলে না, গরম! টাকার গরম!
–টাকার গরম! অত গরম কোনও দিন থাকবে নাকি?
–আরে বাপু, তাই কি থাকে নাকি কোনওদিন। অহঙ্কার বেশি বাড়লে তার পতন অনিবার্য–এই স্পষ্ট কথাটা জেনে রাখো। সেইজন্যেই তো শাস্ত্রে বলছে, অতি দর্পে হতা লঙ্কা অতি মানে চ কৌরবাঃ।
কিন্তু যাই বলুক–এখন পর্যন্ত নিতাই সরকারের সর্বনাশ হবার মতো কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, বরং দস্তুরমত বহাল তবিয়তেই সে আছে চারপাশের গ্রাম থেকে খদ্দেরের ভিড় বাড়ছে তার মনোহারী দোকানে। যেখানে থেকে সে যাই করুক, আর অহঙ্কার তার যতই বাড়ুক, তার অবস্থা এখন উঠতির দিকেই; পতন হওয়ার মতো কোনও লক্ষণ এখন। কোথাও তার চোখে পড়ছে না।
নিতাই সরকারের কিন্তু শান্তি নেই। কী একটা প্রচ্ছন্ন ভয় আছে তার, একটা গোপন আশঙ্কা আছে মনের ভেতরে। ঘুমের মধ্যে কখনও যদি দেওয়ালের গায়ে একটা টিকটিকিও টক টক করে ডেকে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা চলে যায় বন্দুকের ঠাণ্ডা কঠিন নলটার গায়ে। ওই বকের ছানাগুলোর কান্না শুনতে-শুনতে আচ্ছন্ন চেতনার ভেতরে তার মনে হয় যেন কোথায় কার গোঙানি শুনতে পাচ্ছে সে।
সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানার ওপর উঠে বসে। কার মৃত্যু-যন্ত্রণার গোঙানি? কোন অশরীরী। ছায়া-মূর্তির কান্না? আচমকা হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে যায় তার সারা গায়ে ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম ফুটে বেরোয়।
ভুল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেই লজ্জা পায়! না! অসম্ভব। মরা মানুষ আর কখনও ফিরতে পারে না। ফেরার কোনও উপায়ই নেই তার। কোথায় কবে ঘুম-জড়ানো চোখে কিসের একটা ছায়া দেখেছিল,তারই অর্থহীন বিভীষিকা তার সব কিছুকে এমনভাবে বিস্বাদ করে রেখেছে।
তবু কি মন মানে?
আজও মাথার কাছে হাতের নাগালের মধ্যে বন্দুকটা রেখে সে শুয়েছিল। ঘুমুচ্ছিল অকাতরে।
দূরের বাঁশবনে শেয়াল ডাকল রাত বারেটা। সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণের দমকা গুমট ভাবটা গেল কেটে, কোত্থেকে একরাশ ধুলোবালির তরঙ্গ তুলে একঝাঁপটা ঝোড়ো হাওয়া এল ঘরের মধ্যে। সাঁ সাঁ করে উঠল স্তব্ধ নিমগাছটা ঝরঝর করে বটগাছটার ডালপালায় দোলা লাগাতেই ছানাগুলো আর্তনাদ তুলল সমস্বরে।
নিতাই সরকারের ঘুম ভাঙল। ভাঙল আকস্মিকভাবে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সে দেখতে পেল…
কিন্তু যা দেখল তাতে সে বিছানার মধ্যে পাথর হয়ে পড়ে রইল। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারল না বন্দুকটা–দুটো হাতই যেন তার পক্ষাঘাতে অসাড় হয়ে গেছে।
ঘরের মধ্যে একটা মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ–তারই ঘরে। তার চারটে দরজায় শক্ত লোহার তালা সত্ত্বেও দোতলার এই বন্ধ ঘরে সে এসেছে। তার সর্বাঙ্গ একটা কালো আলখাল্লা দিয়ে মোড়ালণ্ঠনের ক্ষীণ শিখাতে দেখা গেল, আলখাল্লার ফাঁকে তার দুটো চোখ যেন দু-টুকরো জ্বলন্ত কয়লার মতো দপদপ করে জ্বলছে।
মানুষ, না প্রেতাত্মা? চোর, না খুনি?
নিতাই চিৎকার করে উঠতে চাইল, পারল না। গলা থেকে তার সমস্ত স্বর কে যেন
একটা ব্লটিং কাগজ দিয়ে শুষে নিয়েছে। শুধু নির্বাক অসহায় চোখে সমস্ত ব্যাপারটা সে দেখতে লাগল। কিছুই করবার উপায় নেই তার করবার মত শক্তিও নেই কোথাও। সে এখন এই অদ্ভুত আগন্তুকের হাতে সম্পূর্ণ অসহায় শিকার।
মূর্তিটা হঠাৎ একখানা হাত থাবার মতো করে তুলে ধরল। লণ্ঠনের আবছা আলোতেই নিতাই দেখতে পেল–সে হাত মানুষের নয়। তীক্ষ্ণধার তার নখ, রোমশ, কর্কশ তার রূপ, আর–আর সে-হাত টকটকে তাজা রক্তে-মাখানো।
সেই হাতখানা বাড়িয়ে মূর্তিটা তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল।
নিতাই আবার চিৎকার করতে চেষ্টা করল–মনে হল মাত্র তিন হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মৃত্যু। কিন্তু এবারও সে কোনও স্পষ্ট আওয়াজ করতে পারল না, কেবল গলার মধ্যে তার ঘড়ঘড় করে উঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। আর খোলা জানলা দিয়ে ক্রমাগত ঘরে এসে ঢুকতে লাগল গোঁ-গোঁ করা ঝোড়ো হাওয়ার এক-একটা উদ্দাম ঝাঁপট।
মূর্তিটা কাছে এলএল একেবারে বিছানার কাছে। তারপর রক্তমাখা সেই হাতখানা নিতাইয়ের বুকের ওপর চেপে ধরল। সে-হাতের ছোঁয়ায় তার গায়ের রক্ত জমাট বেঁধে গেল বরফের মতো।
ফিসফিস করে লোকটা বললে, আমায় চিনতে পারো?
নিতাই জবাব দিলে না। জিভটা তার টাকরার সঙ্গে আঠার মতো লেপটে গেছে।
–আমি শ্ৰীমন্ত রায়।–তেমনি ফিসফিস করে বললে লোকটা, তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র একটা হাসির রেশও যেন বেজে উঠল।