গিরিধারী বললেন, বাবু, আমি একটু মাঠ থেকে আসছি।
–আচ্ছা যা।
গণেশবাবু একা বসে বিড়ি ফুঁকছেন–হঠাৎ বাইরে প্রকাণ্ড দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝলক দমকা হাওয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে একরাশ ধুলোবালিকাঁকর এনে যেন গণেশবাবুর চোখেমুখে ছড়িয়ে দিলে। ঝড় এল নাকি? ধড়ফড় করে উঠে বসতেই গণেশবাবু ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। আধখোলা দরজার পিতলের হাতলের ওপরে একখানা কালো হাত। সে-হাতের মালিককে দেখা যাচ্ছে না বাইরের অন্ধকারে সে মিশিয়ে আছে অথবা আদৌ তার কোনও অস্তিত্ব আছে কি না সেটাই সন্দেহের বিষয়। অস্বাভাবিক ভয়ঙ্কর সে-হাত। তাতে বাঘের মতো বড় বড় নখ, জানোয়ারের মতো রাশি রাশি লোম। গণেশবাবুর মনে হল যে তিনি ভয়ানক একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
সেই হাতটাই যেন রুক্ষ কর্কশ গলায় বললে, সুন্দরপুরের নিতাই সরকারের বাড়ি কোন্ পথে যেতে হয় বলতে পারো?
গণেশবাবু বললেন, তুতু-তুমি কে? হাতটা তেমনি রুঢ় গলায় বললে, তা দিয়ে দরকার নেই তোমার। শুধু আমাকে পথটা বলে দাও, নইলে…
কালো হাতের নখগুলো যেন বাঘের থাবার মতো গণেশবাবুর দিকে এগিয়ে আসতে চাইল।
গণেশবাবুর ধড়ে আর প্রাণ নেই!
–ওই বটগাছের তলা দিয়ে যে রাস্তা, সেই পথ দিয়ে সোজা এগোলেই–
–ধন্যবাদ-এর পুরস্কার তুমি পাবে।
পরক্ষণেই ভীতি-বিহ্বল চোখ মেলে গণেশবাবু দেখলেন, রোমশ কর্কশ কালো হাতখানা দরজার হাতলের ওপর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।
.
দুই
সুন্দরপুরের নিতাই সরকার অঘোরে ঘুমুচ্ছিল।
মেঘের জমাট রাত। ঝড়বৃষ্টির একটা কিছু ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু এখনও স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। শুধু বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে বাইরে নিমগাছে একটি পাতাও নড়ছে না। আর দূরের একটা বটগাছে যেখানে বকের বাসা আছে, সেখানে হঠাৎ ঘুমভাঙা ছানাগুলো থেকে থেকে মানুষের গলায় ককিয়ে কেঁদে উঠছে।
নতুন দোতলা বাড়ি করেছে নিতাই সরকার। তারই দোতলার একটা কোণের ঘরে নিতাই ঘুমুচ্ছে দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে। অসহ্য গরম বলেই জানলা খুলে রাখতে হয়েছে, নইলে যে এতক্ষণে প্রায় সেদ্ধ করে ফেলত। তবে সাধারণত জানলা বন্ধ করে শোওয়াই তার অভ্যাস।
আরও একটা অভ্যাস তার আছে। কিছুদিন আগে বন্দুকের লাইসেন্স নিয়েছে তার মাথার কাছে সব সময় সেটা দাঁড়িয়ে থাকে। থাকে টোটাভরা অবস্থাতেই যাতে হাত বাড়ালেই বন্দুকটাকে সে মুঠোর মধ্যে আঁকড়ে ধরতে পারে, বিছানায় শুয়েই গুলি ছুঁড়তে পারে শত্রুর ওপর।
অবশ্য পাড়াগাঁয়ে যার অবস্থা একটু ভাল, তার চোর-ডাকাতের ভয় অল্পবিস্তর থাকবেই। তা ছাড়া, দেশেও এখন আকাল চলেছে। নিতাইয়ের মতো দু-চারজনের হাতে পয়সা কড়ি এসেছে বটে, কিন্তু বেশির ভাগই পেট ভরে খেতে পায় না আজকাল। খিদের জ্বালায় চুরিচামারির চেষ্টা তারা তো করেই কখনও কখনও দুটো-একটা ডাকাতি যে হয় না তাও নয়।
তবু নিতাই সরকারের ভয়টা একটু বাড়াবাড়ি ঠেকে বইকি।
বাড়াবাড়ি ছাড়া কী আর?
সরকারি থানা আছে এখানে। নিতাইয়ের বাড়ি থেকে সে-থানা আট-দশ মিনিটের রাস্তাও নয়। বেশ বড় গঞ্জ বহু লোকজনের ঘন বসতি আছে। তা ছাড়া সুন্দরপুর ইউনিয়ন বোর্ডের বেশ মাতব্বর লোক নিতাই সরকার–দারোগা ইয়াসিন মিঞার সঙ্গে তার দহরম-মহরমের খবরটাও সকলেরই জানা। এ হেন নিতাই সরকারের বাড়িতে সহজে মাথা গলাবার সাহসই হবে না চোর-ডাকাতের।
তবু লোকটা সতর্ক হয়ে থাকে অতিরিক্ত মাত্রায়।
কোথায় তার মনের মধ্যেই একটা নিঃশব্দ ভয় ঢুকে বসে আছে কে জানে। সন্ধ্যার পরেও নির্জন রাস্তায় একা হটে না। রাত একটু বেশি হয়ে গেলে কোনও অচেনা মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে না। শোবার আগে প্রত্যেকটা দরজায় সে নিজের হাতে তালা লাগায়–ভারি-ভারি শক্ত তালা।
লোকে কানাঘুষো করে। বলে, অনেক টাকা করেছে লোকটা। জমিয়েছে যকের ধন। সেই টাকার জন্যেই এত সব বাতিক দেখা দিয়েছে তার।
কত টাকা? কেউ বলে দশ হাজার, কেউ বিশ হাজার, কেউ পঞ্চাশ হাজার, কারও কারও মতে আরও ঢের বেশি। মোটের ওপর পাঁচ বছর আগেকার গোলদারি দোকানদার নিতাই সরকারের ভাগ্য যে ফিরেছে তা নিয়ে কারও ভেতর মতভেদ নেই।
লোকে হিংসায় জ্বলে। আর সেই হিংসাটা ভোলবার জন্যেই নানাভাবে সান্ত্বনা দেয় নিজেদের।
–আমার টাকাও নেই, ভাবনাও নেই।
–তা যা বলেছ! টাকা থাকলেই আতঙ্ক। খেয়ে সোয়ান্তি নেই, ঘুমিয়ে নিশ্চিন্তি নেই। তার চেয়ে আমরাই বেশ আছি। চোর-ডাকাত আমাদের ফুটোফাটা ঘটিবাটি কোনওদিন ছুঁতেও আসবে না।
–সে তো ঠিক কথা। একটা জিনিস তবুও কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। এত টাকা কোথায় পেল নিতাই সরকার?
ঠিক ওই একটি জিজ্ঞাসাই সকলের মনে ঘুরপাক খায়। কোত্থেকে এত টাকা এল লোকটার? একতলা মাটির ঘর তার পাকা দোতলা হয়ে উঠল। দু-সের ডাল, এক-সের চিনি, পোয়াটাক কাঁচা লঙ্কা আর গোটাকয়েক পেঁয়াজ বেচেই কি কেউ এমন করে লক্ষ্মীর অনুগ্রহ পায়? গ্রামের তারুমুদির দোকান তো অনেক বড়, কিন্তু সেও তো আজ পর্যন্ত মাট-কোঠার ওপর টিনের চালা তুলতে পারল না।
দোকান থেকে নিতাইয়ের যে এই অর্থ-সৌভাগ্যটা ঘটেনি–এটা জলের মতো সরল। পাঁচ বছর আগে নিতাই সেই যে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে কলকাতায় চলে গেল, তারপর মাত্র গত বছর সে গ্রামে ফিরেছে। আর ফিরেই গড়ে তুলেছে লোকে তাক লাগানো এই দালান; সেইসঙ্গে এমন একখানা মনোহারীর দোকান দিয়েছে সে সাতখানা গাঁয়ের মানুষকে ডেকে দেখানোর মতো। বিলিতি মো থেকে হ্যারিকেন লণ্ঠন পর্যন্ত সেখানে কিনতে পাওয়া যায়–শহরকে একেবারে টেক্কা দিয়ে চলে গেছে বলা যেতে পারে। তা হলে আসল রহস্য এই গ্রামে নেই, আছে কলকাতায়। এ-তল্লাটের লোক পারতপক্ষে সুদূর কলকাতা কখনও চোখে দেখেনি। দু-একজন যারা কালীঘাটে পুজো দিতে গেছে, তারা গাড়ি-ঘোড়ার উৎপাত দেখে যেতে না যেতেই পালিয়ে এসেছে পৈতৃক প্রাণটি বাঁচিয়ে নিয়ে।