কাঁপা গলায় গণেশবাবু ডাকলেন, গিরিধারী। ছোট স্টেশনের একমাত্র পয়েন্টসম্যান গিরিধারী স্টেশনের বারান্দায় একটা লোহার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। হাতের পাশেই তার লাল-নীল লণ্ঠনটা রাখা, তা থেকে দুদিকে দুরঙা আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে। তার মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে নেমেছে, গিরিধারী গভীর ঘুমে মগ্ন।
–এই ব্যাটা গিরিধারী—
বিরক্ত গণেশবাবু গিরিধারীকে সজোরে একটা ঠোক্কর লাগালেন। আঁই-আঁই করে গিরিধারী উঠে বসল। বললে, কী হুজুর, কোনও মালগাড়ির কি ঘণ্টি হল?
–না না, কোথায় মালগাড়ি! একা-একা বড় ভয় করছে রে গিরিধারী, আয় একটু গল্প করা যাক।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও গিরিধারী উঠে বসল।
ঢং–আর একটা শব্দ হল ঘড়িতে। রাত একটা।
প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলো সব বেরিয়ে গেছে, শেষরাতের আগে আর ট্রেন নেই। কোয়াটারে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোনো চলে এখন। কিন্তু যুদ্ধের সময়! যখন-তখন একটা মিলিটারি স্পেশ্যাল কিংবা গুডস-ট্রেন এসে পড়তে পারে।
প্যাসেঞ্জারদের জন্যে রাখা লোহার বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়ে একটা হাই তুললেন গণেশবাবু।
-আচ্ছা, এই মাঠ আর জঙ্গলের মধ্যে কোম্পানি একটা স্টেশন কেন বসালে বলতে পারিস?
লাল-নীল লণ্ঠন থেকে একটা রক্তরঙিন আভা গিরিধারীর মুখের ওপর এসে পড়েছিল, আর সেই আলোয় তার চামড়া কুঁচকে যাওয়া বুড়ো মুখোনাকে কেমন নুতন রকমের লাগছিল দেখতে। গণেশবাবুর প্রশ্নে তার চোখ দুটো হঠাৎ যেন চকচক করে উঠল।
–সে অনেক কথা বাবু। অনেক ব্যাপার।
গণেশবাবু কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
–বল, শোনা যাক। বিতিকিচ্ছি রাতটা খানিক গল্প শুনেই কাটুক।
আকাশটা মেঘে আড়ষ্ট হয়ে আছে। রেললাইনের সরু সরু রেখাগুলো প্ল্যাটফর্মের অল্প-অল্প আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে, যেন অন্ধকারের আড়াল থেকে কোনও অশরীরীর একটা নিষ্ঠুর হাসি ঠিকরে পড়েছে তাই থেকে। দূরের বিল আর শ্যাওড়া বনের ভিতর থেকে কতকগুলো শেয়াল একসঙ্গে ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া বলে ডেকে উঠল।
সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গিরিধারী বললে, অনেককাল-সে বহুদিন হয়ে গেল বাবু–এখান থেকে তিনকোশ দূরে নীলকর সায়েবদের একটা ঘাঁটি ছিল। তারা দেশের গরিব চাষাভুষোদের ওপরে যেমন খুশি অত্যাচার করত। জোর করে জমিতে নীল চাষ। দেওয়াত,–যে প্রজা রাজি হত না, চাবুক মেরে তার পিঠের চামড়া তুলে দিত, ঘরবাড়ি আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিত। সাক্ষাৎ শয়তানের অবতার ছিল তারা।
কিন্তু দেশের লোকের রক্তও একদিন গরম হয়ে উঠল বাবুজী। মানুষ কতদিন পড়ে পড়ে খালি মার খাবে? গোরু-ঘোড়াকেও বেশি খোঁচালে তারা গুতো মারতে কিংবা চাঁট ছুঁড়তে চেষ্টা করে, আর এরা তো মানুষ। আশেপাশে দশখানা গাঁয়ের মাথা ছিল বিশাই মণ্ডল, সেই প্রথম বলে বসল, আর আমরা নীলের চাষ করব না। ওতে যা হওয়ার তাই হল, বিশাই। মণ্ডলকে আর পাওয়া গেল না। খবর এল, সায়েবেব লোকেরা নাকি তার ধড়ের থেকে মুণ্ড আলাদা করে মহানন্দা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
শুকনো খড়ের মতো মানুষগুলো তাতিয়ে ছিল, তাতে যেন দেশলাইয়ের আগুন ধরল। আরম্ভ হয়ে গেল প্রলয় কাণ্ড। নীলকরদের সঙ্গে প্রজাদের লড়াই লাগল। ওদের বন্দুক, পিস্তল, এদের তীর-ধনুক, ল্যাজা, টাঙি। দেশের মানুষ সব এককাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে-গুলি খেয়ে মরল, তবু হার মানল না। কদিন পরেই নীলকরেরা তল্পিতল্পা তুলে পালিয়ে বাঁচল।
কিন্তু সেখানেই জের মিটল না। সরকারের ফৌজ এল। দেশের মানুষগুলো তখন লড়ায়ে পল্টন হয়ে গেছে দিনের পর দিন বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে লড়াই করতে লাগল। বিপদ দেখে সরকার এখানে ইস্টিশন বসিয়ে দিলে–যাতে ফৌজ আমদানি করতে অসুবিধে না হয়। তখন ধীরে ধীরে অবস্থা ঠাণ্ডা হয়ে এল, কতক ফৌজের গুলিতে মরে গেল, কতককে ধরে ফাঁসিতে লটকে দিলে।
–আর নীলকুঠি?–গণেশবাবু সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
–তারাও সেখানেই শেষ হল বাবুজী–গিরিধারী হাসল। বললে, অনেক মানুষ জান দিলে বটে, কিন্তু সে-শয়তানেরও দফা নিকেশ করে দিয়ে গেল। সায়েরা সেই যে পালাল আর এ-মুখো হয়নি গিরিধারী একটা নিঃশ্বাস ফেললে : সেসব মানুষ আর নেই বাবুজী। এখন যারা আছে তারা ভয়েই কাবু, গায়ে তাকত নেই, বুকে পাটাও নেই।
গণেশবাবু বললেন, সেনীলকুঠির বাড়িটা?
–এখন জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে নদীর ধারে। ভয়ানক ভূতের আস্তানা। লোকে সেদিকে এগোয় না।
গণেশবাবু চুপ করে ভাবতে লাগলেন। ভূতের কথা নয়-সেইসব মানুষের কথা-যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্যে একদিন বন্দুক পিস্তলের মুখে অসঙ্কোচে বুক পেতে দিয়েছিল আর সেই অন্যায়কে দূর করে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছিল। সেরকম দরাজ চওড়া বুকওয়ালা মানুষ দুনিয়া থেকে কি লোপাট হয়ে গেল নাকি? তারা কি আর ফিরবে না!
ঘরের মধ্যে টেলিফোনটা ঘটাং করে উঠল। গণেশবাবুর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল, তিনি ফোন ধরলেন।
হ্যালো, হ্যালো, থ্রি-নাইন্টি-থ্রি? ফাইভ নাইন—
ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, ঘণ্টা দে গিরিধারী, মিলিটারি স্পেশ্যাল আসছে, পাখা নামিয়ে দে।
ঝনঝন করে রেললাইনের পাশে সিগন্যালের তারে টান পড়ল–সিগন্যালের সবুজ চোখ মিলিটারি স্পেশ্যালকে জানাল আসবার সঙ্কেত। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সার্চলাইটের আলোয় বান ডাকিয়ে আর লোহায় লোহায় যেন ঝড় তুলে মিলিটারি স্পেশ্যাল ছুটে বেরিয়ে গেল। ছোট স্টেশন মানিকপুরে তার থামবার কথা নয়, সে থামলও না।