অদৃশ্য স্বর বলল, মনে আছে বিরিঞ্চি, একদিন এই শ্ৰীমন্ত রায় আদর্শ ভালো ছেলে ছিল? বন্ধু হয়ে তার কাছে তুমি এগিয়ে এলে, তারপর–
বিরিঞ্চি বলল, ওসব কথা কেন?
–বাধা দিয়ো না। মনে রেখো, আজ তোমার বিচার। গোড়া থেকে সব কথাই তোমায় শুনতে হবে।
বিরিঞ্চি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, বলে যাও।
–আমার টাকা ছিল–আমি ছিলাম সরল, ছিলাম নিবোধ। নির্বুদ্ধিতার সুযোগ নিয়ে তুমি আমাকে নিয়ে ভিড়িয়ে দিলে রেসের মাঠে। যত বাজি হারতে লাগলাম, টাকাগুলো যত পাখনা মেলে উড়ে যেতে লাগলযত আমি পালাতে চেষ্টা করতে লাগলাম, ততই আমায় তুমি আঁকড়ে রাখলে। দুঃখ ভোলাবার জন্যে ধরালে মদসর্বনাশের রাস্তা সহজ করে দিলে।
বিরিঞ্চি আবার উসখুস করে উঠল।
–দাঁড়াও বিরিঞ্চি, দাঁড়াও শ্ৰীমন্ত রায়ের তিক্ত গলা শুনতে পাওয়া গেল : সেদিন ভিক্ষুক করে যদি তুমি আমায় ছেড়ে দিতে তাহলে আমি তোমায় ক্ষমা করতাম। কিন্তু সেইখানেই তুমি থামলে না। যখন তুমি আমাকে নিঃস্ব করে দিলে, তখন নিয়ে এলে লোভ। আর সেই লোভের ফাঁদে আমি অসহায়ের মতো পা দিলাম।
বিরিঞ্চি জবাব দিল না।
–মদের নেশায় তখন আমার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান ছিল না। সেই সুযোগে একটা জালিয়াতির ব্যাপারে তুমি আমায় জড়িয়ে দিলে। তখন আমার ঘোর ভাঙল। দেখলাম, এখন আমায় যে করে হোক তোমার হাত থেকে পালাতেই হবে। কিন্তু সে-পথ তুমি আমার রাখোনি। আমার মৃত্যুদণ্ড তোমার মুঠোর মধ্যে। যেসব কাগজপত্র তোমার কাছে ছিল তা দিয়ে অনায়াসে তুমি আমাকে সাত বছর জেল খাটাতে পারতে। নিরুপায় হয়ে তোমার দয়াতেই নিজেকে আমি সঁপে দিলাম।
কাতর গলায় বিরিঞ্চি বললে, ভুলে যাও শ্ৰীমন্ত, ভুলে যাও। ওসব পুরনো কথা কেন টেনে তুলছ?
–বলেছি তো, আজ তোমার বিচার। সব শুনতে হবে বিরিঞ্চি। সংক্ষেপেই বলব, কিন্তু একটা শব্দও বাদ দেওয়া চলবে না। পৃথিবীতে অনেক শয়তান জন্মেছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও কিছুনা-কিছু মনুষ্যত্ব ছিল। কিন্তু ওসবের বিন্দুমাত্র বালাই তোমার ছিল না বিরিঞ্চি। এদিক থেকে তুমি নিরঙ্কুশ-তোমার তুলনা হয় না।
–শ্ৰীমন্ত!
–আজ তোমার গলা কাঁপছে কেন বিরিঞ্চি? কোনও অন্যায়–কোনও পাপেই তো কখনও তুমি এতটুকু টলোনি! আজ এ-দুর্বলতা কেন তোমার! এখন যা বলছি–নিঃশব্দে শুনে যাও।
বিরিঞ্চি নিরুত্তর হয়ে রইল। আহত ডানহাতের তালুতে তীব্র যন্ত্রণা। বুড়ো আঙুলের তলাকার হাড়টা গুঁড়ো হয়ে গেছে, এখনও রক্ত পড়ছে গড়িয়ে। সেটাকে প্রাণপণে টিপে ধরে বিরিঞ্চি বসে রইল।
–তারপর–অদৃশ্য শ্ৰীমন্ত বলে চলল : তারপর থেকে আত্মরক্ষার কোনও উপায় আমার আর রইল না। নিরাপদে পেছনে বসে থেকে আমায় পাপের পথে ঠেলে দিতে লাগলে। চুরি, জুয়াচুরি, জালিয়াতি, ডাকাতি–কিছুই বাদ গেল না। আর এমনি কায়দায় তুমি কাজগুলি করতে যে, ধরা পড়লে আমি জেলে যাব, তোমার গায়ে কুটোটির আঁচড়ও লাগবে না। খুব বুদ্ধিমানের মতো ব্যবস্থা, সন্দেহ কী! নির্বাক মুখে আমি তোমার প্রত্যেকটি আদেশ পালন করে চললাম। জানতাম, একবার যদি তোমার হুকুম অমান্য করি, তুমি আমায় সাত বছরের মতো জেলখানায় ঘানি ঘুরোতে পাঠিয়ে দেবে।
–থামো শ্ৰীমন্ত!–বিরিঞ্চি আর্ত হয়ে বলল, আর কেন ওসব? যেতে দাও ওসব কথা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার এসো-নিতাইয়ের টাকাটা আমরা ভাগাভাগি করে নিই রফা হয়ে যাক সবকিছু।
–ঘুষ?-শ্ৰীমন্তর হাসি শোনা গেল : লোভ দেখাচ্ছ আমাকে। কিন্তু ও-চালাকি পুরনো হয়ে গেছে বিরিঞ্চি হালদার, ওতে আর আমায় ভোলাতে পারবে না। তোমার কথার দাম কতখানি, একটু আগেই অনাদি তার পরিচয় পেয়ে গেছে। আমাকে অত বোকা তুমি ভেবো না।
–বিশ্বাস করো, একবার সুযোগ দাও আমাকে–বিরিঞ্চি প্রার্থনা করল।
–সুযোগ তুমি অনেক পেয়েছ বিরিঞ্চি, আর নয়। সব সুযোগেরই একটা সীমা আছে। ও-সব কথা এখন থাক। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমার প্রতি শেষ কর্তব্য তুমি পালন করলে কেশবদাস মাগনিরামের ব্যাপারে। আমাকে ছোরাটা ঠিকই মেরেছিলে তোমরা, কিন্তু কপাল-জোরে আমি বেঁচে গেলাম। কী করে? সে অনেক কথা। কিন্তু তারপরেই মনে হল, তোমরা তিনজন–তুমি, অনাদি আর নিতাই তোমাদের কাছে আমার অনেক ঋণ। সে-ঋণ আমায় শোধ করতেই হবে। বিশেষ করে তুমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ মহাজন।
বিরিঞ্চি চিৎকার করে উঠল : আমায় ছেড়ে দাও শ্ৰীমন্ত! এ-টাকার সবটা তুমিই নাও–শুধু আমাকে মুক্তি দাও, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
–ক্ষমা?-শ্ৰীমন্ত আবার সেই ভয়ঙ্কর হাসি হাসল : তোমাকে ক্ষমা করবার পরিণাম কী, আমি কি তা জানিনে বন্ধু? গোখরোর মতো তুমি আমায় খুঁজে বেড়াবে–তোমাকে হাড়ে হাড়ে আমি চিনি। আর আমাকে যদি তুমি নাই পাও, আমার মতো আরও কতজনের সর্বনাশ যে তুমি করবে তার হিসেব নেই। আইন তোমায় ধরতে পারবে না–এতই তুমি সতর্ক। কাজেই আজ আমার কাছ থেকে তোমায় দণ্ড নিতে হবে।
–শ্ৰীমন্ত!
–উঠে দাঁড়াও বিরিঞ্চি!–বজ্রের মতো আদেশ এল।
–শ্ৰীমন্ত!
–উঠে দাঁড়াও, নইলে গুলি করব।
বিরিঞ্চি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়াল।
–ডানদিকে ঘুরে দাঁড়াও।
–আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও শ্ৰীমন্ত?
–এখুনি জানতে পারবে। ডানদিকে ফেরো। হ্যাঁ–আরও, আরও দু-পা। এবার হাঁটতে আরম্ভ করো। পালাতে চেষ্টা কোরো না বিরিঞ্চি। মনে রেখো, আমার অশরীরী চোখ আর হাতের রিভলভার তোমার সবকিছু লক্ষ করছে।