–কী এ?
–চেকবই।
–চেকবই! এ যে আমার ব্যাঙ্কের চেকবই! এ কোথায় পেলে?
বিরিঞ্চি মুচকি হাসল : কোন্ ব্যাঙ্কে টাকা আছে জানলে চেকবই যোগাড় করা এমন আর শক্তটা কী! নাও–সই কর–
–আমি সই করব না। কালো রিভলভারটা নাচিয়ে বিরিঞ্চি বললে, করবে না?
–না!
–তা হলে অনাদির দিকে একবার তাকাও।
–দাও সই করছি নিতাই হাত বাড়াল : কিন্তু কলম?
–এই নাও–পকেট থেকে ফাউন্টেন পেন বার করে দিল বিরিঞ্চি।
–কত টাকা লিখব?
রিভলভারটা নাচিয়ে বিরিঞ্চি বললে, লিখবে হবে না–শুধু সই কর।
–তার মানে? ব্ল্যাক চেক?
–হাঁ ব্ল্যাঙ্ক চেক।
সভয়ে নিতাই বলল, তুমি যদি আমার সব টাকা তুলে নাও?
–বন্ধুকে বিশ্বাস করো।
–না, সই করব না!
–তা হলে–বিরিঞ্চি পিস্তল বাগিয়ে ধরল।
–দাও সই করেছি–খসখস করে চেকে স্বাক্ষর করে দিল নিতাই। তারপর মাথায় হাত দিয়ে মেঝেয় বসে পড়ল। আজ তার সব গেল–আজ সে পথে বসেছে। কিন্তু কিন্তু নিতাইয়ের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠল। এর শোধও সে নিতে পারবে। ও টাকা হজম করবার ক্ষমতা বিরিঞ্চির হবে না।
নিতাই বলল, এবার আমাকে যেতে দাও–
–হ্যাঁ দিচ্ছি, বিরিঞ্চি রক্তমাখা ছোরাটা হাতে তুলে নিলে। মোমবাতির আলোয় ঝিকিয়ে উঠল রাক্ষসের জিভ। ছোরাটা শক্ত করে মুঠোর মধ্যে আঁকড়ে ধরে বিরিঞ্চি এগুতে লাগল নিতাইয়ের দিকে।
নিতাই সভয়ে চেঁচিয়ে উঠল এ কী!
এবার বিরিঞ্চি শব্দ করে হাসল, টেনে টেনে হাসল।
–নিতাই সরকার, ভেবেছ তুমিই সবচেয়ে চালাক, তাই নয়? আজ চেকে সই করে দিয়েছ, কালই কলকাতায় ব্যাঙ্কে তুমি টেলিগ্রাম করে দেবে, তারপর চেক ভাঙাতে গেলেই আমার হাতে দড়ি পড়বে। না–অত বোকা আমি নই।
পাংশু পাণ্ডুর মুখে নিতাই বলল, তুমি কী করতে চাও?
–শত্রুর শেষ রাখব না—
তীরের মতো বেগে নিতাই দাঁড়িয়ে উঠল, টেনে বার করে আনল রিভলভারটা। কিন্তু তার আগেই বিরিঞ্চির ছোরা তার বুকে এসে বিধেছে। নিঃশব্দে একটা ভারি বস্তার মতো অনাদির রক্তাক্ত দেহের ওপর গড়িয়ে পড়ল নিতাই।–একটা আর্তনাদ করবারও সময় পেল না। বিরিঞ্চি গর্জে উঠল–কেল্লা ফতে। আর সেই মুহূর্তেই কঠিন ভয়াবহ গলায় কে বলল, একটু দাঁড়াও বিরিঞ্চিসটা এখনও শেষ হয়নি।
সাপের ছোবল খাওয়ার মতো লাফ দিয়ে উঠল বিরিঞ্চি। শ্ৰীমন্ত রায়ই বটে। কোনও সন্দেহ নেই–শ্ৰীমন্ত রায়েরই কণ্ঠস্বর!
তীরবেগে বিরিঞ্চি রক্তমাখা ছোরাখানা তুলে ধরল। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। চারদিকের অন্ধকার সীমাহীন সমুদ্রের মতো। তার ভেতর কিছুই চোখে পড়ল না। অন্ধকারের মধ্যে আবার সেই ভয়ঙ্কর স্বর উঠল : রিভলভারটা হাত থেকে ফেলে দাও বিরিঞ্চি।
শ্ৰীমন্ত রায়! বিকট গলায় বিরিঞ্চি চেঁচিয়ে উঠল। তারপর শব্দ লক্ষ্য করে ছোরা তুলে ঝাঁপ দিতেই দুম করে এল একটা গুলির আওয়াজ। অসহ্য যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল বিরিঞ্চি–আহত হাত থেকে শব্দ করে ছোরাখানা ঝনঝন করে মেঝের ওপর খসে পড়ল!
বাঁ হাতে বিরিঞ্চি রক্তঝরা ডান হাতখানা চেপে ধরল, তারপর আতঙ্কে বিহ্বল চোখ মেলে চেয়ে রইল রহস্যময় অন্ধকারের ভেতর। সামনেই কোথাও তার অদৃশ্য শত্ৰু মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লক্ষ করছে তার প্রত্যেকটি চাল-চলন, তার প্রত্যেকটি কাজ। এই অলক্ষ্য আততায়ীর কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার কোনও উপায় নেই।
সহসা শ্ৰীমন্ত রায় আবার বলল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো বিরিঞ্চি! যা বলি, তা মন দিয়ে শোনো। অনেক অপরাধ তুমি করেছ, তার জন্যে আজ তোমায় দণ্ড নিতে হবে। কিন্তু বিনা বিচারে শাস্তি তোমায় দেব না। তোমার কী জবাবদিহি করবার আছে, আগে তাই শুনে নিতে চাই।
বিকৃত স্বরে বিরিঞ্চি বলল, সাহস থাকে তো সামনে এসে দাঁড়াও শ্ৰীমন্ত রায়। অমন করে কাপুরুষের মতো আড়ালে থেকো না!
–কাপুরুষ।–হা-হা করে একটা বীভৎস হাসির আওয়াজ পোভড়া বাড়িটার থমথমে ভৌতিক রাত্রিকে কাঁপিয়ে তুলল–একথা অন্তত তোমার মুখে মানায় না বিরিঞ্চি। হাটলোর ফাঁকা পাটগুদামে পেছন থেকে আমার পিঠে ছোরা মারবার সময় এবীরত্ব তো তোমার ছিল না!
বিরিঞ্চি বলল, থামো থামো, শুধু একটা কথার জবাব দাও। তুমি কি মানুষ–অথবা প্রেত? মৃত্যুর ওপার থেকেই তুমি প্রতিশোধ নিতে এসেছ?
শ্ৰীমন্ত রায়ের অলক্ষ্য কণ্ঠ আবার তীক্ষ্ণ ভয়ঙ্কর মুখর হয়ে উঠল, বলল, সে-প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু ডান হাতটা খুইয়েছ বিরিঞ্চি, আবার বাঁ হাতটাও খোয়াতে চাও? হ্যাঁ, তোমায় স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি। পকেটে হাত দিতে চেষ্টা কোরো না-ওখানে তোমার পিস্তল আছে তা আমি জানি। এও জানি যে, বাঁ হাতেও তুমি সব্যসাচীর মতো গুলি চালাতে পারো।
সভয়ে বাঁ হাতটা পকেট থেকে টেনে বার করে আনল বিরিঞ্চি। কাঁপা গলায় বলল, তুমি কী বলতে চাও?
–সেটা বলতেই তো চেষ্টা করছি, কিন্তু তার আগে তোমাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। অস্থির হয়ে উঠলে নিজের ক্ষতি নিজেই আরও বেশি করবে আশা করি সেটা বুঝতে পারছ।
–কী করতে হবে?–হতাশ স্বরে বিরিঞ্চি জানতে চাইল।
–বসো ওই মেঝের ওপর।
বিরিঞ্চি বসল। টের পেল তলায় একটা ঠাণ্ডা আঠার স্রোত। মুহূর্তে বিরিঞ্চির সারা শরীর কুঁকড়ে উঠল। নিতাই অথবা অনাদির রক্ত–অথবা দুজনেরই। কিন্তু একতিল নড়ে বসতে তার সাহস হল না।