আর কেউ নয়–নিতাই সরকার।
.
দশ
নিতাই খানিকক্ষণ বিহ্বলভাবে দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকার নীলকুঠির সামনে। বাতাস উঠেছে। চারদিকের বন-জঙ্গলে বাজছে একটা ভৌতিক মর্মর–যেন অতীতযুগের যত প্রেতাত্মা আজ এই অন্ধকার রাত্রে নীলকুঠির জঙ্গলে হানা দিয়েছে। অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে ঝোপে ঝাড়ে–তাদের হিংস্র চোখ থেকে ঠিকরে-পড়া আগুনের স্ফুলিঙ্গ যেন।…
নিতাইয়ের বুক কাঁপতে লাগল। এ কোথায় এল কার সর্বনাশা আকর্ষণে এখানে এসে পড়ল সে? জঙ্গলের কোলে ঘন অন্ধকার যেন তাকে ঠেসে ধরেছে, যেন তার দম আটকে আসছে! কে এই বন্ধু–এমন অস্থানে এমন অসময়ে তাকে ডেকে আনল? সে কি সত্যি সত্যিই বন্ধু, না কোনও শত্রুর ফাঁদ?
নিতাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ, ভয়ব্যাকুল চোখ দুটো বুলিয়ে নিল পোড়ো নীলকুঠির ভয়াবহ রহস্যময়তার ওপরে। তারপর চেপে ধরল পকেটের রিভলভারটা। নিজের অস্ত্রটার নিষ্ঠুর শীতল স্পর্শে তার নিজের শরীরটাই যেন শিউরে উঠল।
ফিরে যাবে? বোধহয় ফিরে যাওয়াই ভাল, কিন্তু যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই সে চমকে লাফিয়ে উঠল। তার কাঁধের ওপর কার একখানা হাত পড়েছে। যেন মানুষের হাত নয়, চারিদিকের আঁধারই একখানা লম্বা হাত বার করে তার কাঁধের ওপর রেখেছে।
অস্বাভাবিক গলায় নিতাই বলল, কে?
আঁধারের ভেতর থেকেই জবাব এল, এসো—
নিতাই পকেটের রিভলভারটা ধরবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু ভয়ে আর উত্তেজনায় তার হাতটা থরথর করে কাঁপছে। তেমনি বিকৃত গলায় সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে?
জবাব এল, বন্ধু!
ওরা কেউ দেখতে পায়নি, একটু দূরে আর-একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। তার মুখ মানুষের নয়, কঙ্কালের। তার হাত মানুষের নয়, গরিলার মতো, বড় আর সেই হাতখানা টকটকে রঙে রঙিন।
কঙ্কাল-মূর্তিটা নিঃশব্দে হাসছিল–হঠাৎ তার হাড়ের দাঁতগুলো খটখট করে বেজে উঠল।
নিতাই চমকে বলল, ও কী?
বন্ধু জবাব দিল, কিছু না–বোধহয় কটকটে ব্যাঙ।
.
ঘরে ঢুকে মোমবাতির আলোটা জ্বালাল বিরিঞ্চি। তারপর নিজের পিস্তলটা নিতাইয়ের দিকে ঘুরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নিঃশব্দে একটা ভয়ঙ্কর হাসি হেসে বলল, চিনতে পারছ?
ততক্ষণে আতঙ্কে পাথর হয়ে গেছে নিতাই। মোমবাতির মৃদু আলোয় চোখে পড়ছে ঘরের ভেতরের বীভৎস সেই অমানুষিক দৃশ্যটা, মেঝেতে তাজা রক্তের স্রোত বইছে–নিতাইয়ের পায়ের নীচে সেরক্ত আঠার মতো চটচট করে উঠল। আর রক্তের সেই পৈশাচিক সমারোহের মধ্যে পড়ে আছে একটা মৃতদেহ–মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রসারিত হাতের দুটো মুঠি শক্ত করে আঁটা, অন্তিম যন্ত্রণায় পায়ের আঙুলগুলো পর্যন্ত দোমড়ানো।
কিন্তু তার চাইতেও বড় বিভীষিকা নিতাইয়ের সামনেই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাসছিল। তার হাতের ছোট রিভলভারের নলটা তারই বুকের দিকে উদ্যত হয়ে আছে তার শাদা শাদা বড় বড় দাঁতগুলো ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো যেন তাকে তাড়া করে আসছে।
নিতাই অস্ফুট গলায় বলল, বিরিঞ্চি।
বিরিঞ্চি আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল মৃতদেহটার দিকে : আর অনাদি।
নিতাইয়ের সমস্ত জ্ঞান যেন লুপ্ত হয়ে গেল–মাথা ঘুরে রক্তাক্ত মেঝের ওপরেই বসে পড়ল সে। শুধু তেমনি করেই, সামনে দাঁড়িয়ে পিশাচের মতো হাসতে লাগল বিরিঞ্চি।..কয়েক মিনিট পরে নিতাই উঠে দাঁড়াল। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল অনাদিকে কে খুন করেছে?
–আমি।
–কেন?
–দরকার ছিল। কিন্তু বিরিঞ্চি বিকটভাবে সেইরকম শব্দহীন হাসি হাসল : ভয় নেই, তোমাকে খুন করব না। বলছি তো, আমি তোমার বন্ধু।
–বন্ধু! কী রকম বন্ধু তা আমি জানি। নিতাইয়ের হাত-পা কাঁপছে : আমার কাছে তুমি কী চাও?
–কিছুই না–পুরনো বন্ধু, একটু আলাপ-পরিচয় আর কি। বিরিঞ্চি নিশ্চিন্তভাবে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল : তাছাড়া একটু দাবিও আছে। আশা করি বন্ধুকে বিমুখ করবে না।
–কী দাবি?
–কিছু টাকা—
–কীসের টাকা?
–কেশবদাসের সিন্দুক থেকে নেওয়া হাজার টাকার অর্ধেক—
–সে-টাকার আমি কিছু জানি না–
–জানো না? বিরিঞ্চি তেমনি হাসতে লাগল : একথা তোমার কাছ থেকে একেবারে আশা করিনি, তা নয়। লজ্জা কী বন্ধু, সত্যি কথাটা সবাই জানে। সবই চাই না, মাত্র সাড়ে সাত হাজার পেলেই আমি চলে যাব–
–মিথ্যে কথা, আমার টাকা নেই।
–নেই? নিশ্চিন্তভাবে বিরিঞ্চি বললে, তোমার টাকা নেই? আমার রিভলভারে টোটা আছে। অনর্থক কেন বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটাচ্ছ বল দেখি? রাজি হয়ে যাও
–সে টাকায় তোমার দাবি নেই, আছে শ্ৰীমন্ত রায়ের—
–একই কথা। দাও, টাকাটা দিয়ে ফেলো চটপট—
–না।
–দেবে না? বিরিঞ্চি অনাদির মৃতদেহটা দেখিয়ে দিল, ক্ষুব্ধস্বরে বলল, তা হলে আমাকে আর-একটা খুন করতেই হল দেখা যাচ্ছে–
নিতাই আর্তনাদ করে উঠল, হাতটা চলে গেল পকেটের ভেতর।
–খবরদার!
হঠাৎ আকাশফাটানো গলায় চেঁচিয়ে উঠল বিরিঞ্চি : খবরদার, আমি জানি তোমার পকেটে পিস্তল আছে। কিন্তু বার করবার চেষ্টা কোরো না তার আগেই মিছিমিছি প্রাণটা খোয়াবে।
বিরিঞ্চির পিস্তলটা নিতাইয়ের প্রায় বুকের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে ট্রিগারে একটা আঙুল তৈরি হয়ে আছে।
হাল ছেড়ে দিল নিতাই। হতাশভাবে বলল, কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই–
–না, তোমার ব্যাঙ্কে আছে। সে আমি জানি। তা ভালো, ছেলের মতো এটা সই করে দাও দেখি–