বুকটা ঢিপঢিপ করছিল কিন্তু নিতাই সংযত করল নিজেকে। নাঃ, ভয় পেলে তার চলবে না, ঘাবড়ে গেলে সব মাটি হয়ে যাবে। হয় শ্ৰীমন্ত রায়ের আজ একদিন, অথবা তার শেষ। এসপার কিংবা ওসপার।
কিন্তু এই বন্ধুটি কে?
সবই রহস্যময়। তবু দেখা যাক। হাতের মধ্যে রিভলভারটা শক্ত করে বাগিয়ে ধরে সে এগুতে লাগল।
অন্ধকার, নির্জন গ্রামের পথ। চারদিক থমথম করছে, পাতাটি কোথাও নড়ছে না। শুধু আকাশের তারাগুলো যেন হিংস্রভাবে জ্বলছে, আর দূরে-দূরে জ্বলছে আলেয়া। একটা কুকুর তাকে দেখে খেঁকিয়ে উঠল–নিতাই ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে চলল।
কিন্তু সে যা টের পায়নি–অন্ধকারের ভেতরে একটি ছায়ামূর্তি তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে আসছে। সে থামলে থামছে, এগুলে এগুচ্ছে। সেই মূর্তির মুখ মানুষের নয়–নরকঙ্কালের। তার অস্থিময় মুখের কোটরের ভেতরে দুটো চোখ আগুনের হলকার মত ঝিলিক দিচ্ছে। তার হাত মানুষের হাত নয়–সে-হাত গরিলার হাতের মতো বড়,–এক ইঞ্চি পরিমাণ ধারালো বড় বড় তার নখ, আর কুচকুচে কালো সেই হাতখানা টকটকে রক্তে রাঙানো।
.
নয়
তখনও রক্ত, তার একটা প
নীলকুঠির জঙ্গল। নীলকুঠির ভুতুড়ে বাড়িটা ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ ঘরেরই দেওয়াল আছে, ছাত নেই। দরজা জানলাগুলো ভেঙে কবে যে ধুলোয় মিশে গেছে কেউ তা বলতে পারে না। বাড়িটার এখানে-ওখানে সর্বত্র শিকড় জেগেছে, মাথা তুলেছে ছোটবড় অশ্বথ গাছের সারি। কালো অন্ধকারে ঢাকা সেইসব অশ্বথের থেকে মাঝে মাঝে একটা কালপ্যাঁচা ভুতুড়ে গলায় ধু-ধু-ধু-ধু-ম শব্দ করে ডেকে উঠছে।
এই বাড়ির একটা ভাঙা ঘরের ভেতরে একটা মোমবাতির আলো মিটমিট করে জ্বলছে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরিঞ্চি। তার হাতে একখানা ধারালো ছোরার আঠারো। ইঞ্চি ফলা মোমবাতির আলোয় রাক্ষসের জিভের মতো লকলক করছে। মেঝেতে শুয়ে। আছে অনাদি–তার একটা পায়ে ময়লা ন্যাকড়ার ব্যাস্তেজ বাঁধা, তা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে তখনও রক্ত পড়ছে। দুটো হাত শক্ত করে বাঁধা অনাদির-চোখ দুটা ভয়ে যেন কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে।
কাতর অসহায় কণ্ঠে অনাদি বললে, আমাকে মেরো না।
বিরিঞ্চি হেসে উঠল। জোরে নয়–চাপা, নিষ্ঠুর তার হাসি। তারপর অনাদির কথার জবাব না দিয়ে আঙুলের মাথায় ছোরাটার ধার পরীক্ষা করতে লাগল। এক ঘায়ে একেবারে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া যাবে কি না সেটাই দেখছে।
অনাদি আবার কাতর স্বরে বললে, কেন আমাকে মারবে? আমি কী করেছি?
–তোমাকে না মারলে আমার উপায় নেই।
–কেন?
–তোমার পায়ে চোট লেগেছে শ্ৰীমন্ত রায়ের গুলি উরু দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তুমি পালাতে পারবে না–ধরা পড়বেই। তারপর তোমার দৌলতে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। কাজেই আগেভাগে নিশ্চিন্ত হতে চাই।
–মিথ্যাবাদী, শয়তান–অনাদি গর্জে উঠল : তোমার মতলব আমি বুঝতে পেরেছি। নিতাই সরকারের কাছ থেকে যে-টাকা আদায় করবে ভেবেছ, তার ভাগ আমাকে দিতে চাও না। তাই তোমার এইসব ছুতো! শ্ৰীমন্ত রায়ের গুলি না লাগলেও তুমি আমাকে খুন করতে।
–তা করতাম–নির্বিকার নিরাসক্ত গলায় বিরিঞ্চি জবাব দিল।
–এই তোমার বন্ধুত্ব?
–শয়তানে শয়তানে বন্ধুত্ব এইরকমই হয় বন্ধু–আবার হিংস্র চাপা গলায় বিরিঞ্চি হেসে উঠল : স্বার্থসিদ্ধি হলে সবটা একা গ্রাস করবার জন্যে হয় তুমি আমায় খুন করবে, নইলে আমি তোমায় খুন করব। ভাগ্যবলে চান্সটা আমি পেয়েছি–ছাড়ব কেন?
–রাক্ষস, শয়তান–অনাদি আর্তনাদ করে উঠল।
–যা খুশি বলতে পারো, নির্বিকারভাবেই বিরিঞ্চি জবাব দিল–মেল-ট্রেনের টাকাগুলো বাগানোর চেষ্টা বৃথা হয়ে গেল বাগড়া দিল শ্ৰীমন্ত রায়। নিতাইয়ের কাছ থেকে যা পাওয়া যাবে, তাতে আমার নিজেরই কুলোবে না। কাজেই তোমাকে আর ভাগীদার রাখতে চাই না। এবার শ্ৰীমন্ত আর নিতাইকে কাবার করতে পারলেই আমার পথ পরিষ্কার।
অনাদি আবার বলল, শয়তান, বিশ্বাসঘাতক!
–বড্ড গালাগাল দিচ্ছ, আর বেশিক্ষণ তোমার বাঁচা উচিত নয়। রেডি হও। ওয়ান–টু–
ছুরি হাতে বিরিঞ্চি এগুতে লাগল।
বিস্ফারিত ভীত চোখে অনাদি পালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারল না।
–আমাকে মেরো না, তোমার পায়ে পড়ি মেরো না, আমি ভাগ চাই না, আমাকে ছেড়ে দাও! অনাদির অসহায় চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
তা হয় না–বিরিঞ্চির গলার স্বর পাথরের মতো কঠিন।
–আমাকে মেরো না–আমাকে মে—
মোমবাতির আলোয় ছোরাতে বিদ্যুৎ ঝকে উঠল। ধপ করে সেটা নেমে এল অনাদির বুকের ওপরে, বসে গেল বাঁট পর্যন্ত। আঁ–আঁ–আঁ।
অন্তিম আর্তনাদ। বারকয়েক হাত-পা ছুঁড়েই শান্ত হয়ে গেল। অনাদির বিস্ফারিত চোখের ওপর নেমে এল শাদা কাপড়ের একটা পদা। আর বিরিঞ্চি ছোরাটা ফস করে সজোরে টেনে বার করে আনতেই একহাত উঁচু হয়ে ছিটকে বেরুল রক্তের ফোয়ারা। লাগল দেয়ালে, লাগল বিরিঞ্চির গায়ে।
অনাদির জামাটাতে ছোরার রক্ত মুছে নিয়ে বিরিঞ্চি সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখে নিশ্চিন্ততার একটুকরো হাসি। একটা আপদ গেছে, আরও দুটো বাকি। তাদের অবস্থাও এমনিই হবে।
ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা সে নিবিয়ে দিল। ঘরে ঘনিয়ে এল ভৌতিক কৃষ্ণ ছায়া। প্যাঁচাটা আবার ডেকে উঠল : ধু-ধু-ধু-ম-ধু-ধু-ধুম।
এমন সময় জঙ্গলের ভেতরে একটা তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ল–যেন তলোয়ারের ফল চিরে দিল নীলকুঠির জঙ্গলের প্রেচ্ছন্ন রাত্রিকে।