হ্যাঁ-এক বছর আগেকার ঘটনা। পটলডাঙার এক মেসবাড়িতে সে তখন আস্তানা নিয়েছিল। হঠাৎ নিশিরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে ভোলা জানলায় তার চোখ পড়েছিল। রাস্তা থেকে অল্প অল্প গ্যাসের আলো আসছিল, সেই আলোয় দেখেছিল, ছায়ামূর্তির মতো একজন মানুষ ওখানে দাঁড়িয়ে।
আর এক লহমায় সে মানুষটাকে চিনতে পেরেছিল–আবছা আলোতে তার ভুল হয়নি একবিন্দু। সে আর কেউ নয়–শ্ৰীমন্ত রায়। নিজের চোখ দুটোকে ভালো করে বিশ্বাস করবার আগেই মূর্তিটা মিলিয়ে গিয়েছিল হাওয়ায়–মিলিয়ে গিয়েছিল ব্ল্যাকআউটের কলকাতার রহস্যময় অন্ধকারে।
সেই থেকে একটা আশ্চর্য ভয় সঞ্চারিত হয়ে গেছে নিতাইয়ের চেতনায়। ভূতের ভয়, অশরীরীর ভয়। তারপরেই নিতাই কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছিল। রাত্রির অন্ধকার এলেই তার শরীর ছমছম করে উঠত, থমথম করে উঠত মন। মাঝে মাঝে আশঙ্কা হত, গভীর রাত্রে তার ঘরের চারপাশে যেন শিকারি বিড়ালের মতো পা ফেলে শ্ৰীমন্ত রায় চলে বেড়াচ্ছে। তার সর্বাঙ্গ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, তার চোখে দপদপ করে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন।
অবশেষে বিভীষিকা কিনা সত্যি-সত্যিই এসে দেখা দিল। বাইরে বাতাস গোঙাচ্ছে–অন্ধকার আমবাগান যেন আছাড়ি-পিছাড়ি করছে একটা প্রবল আক্রোশে। হঠাৎ ধড়াস করে একটা শব্দ হয়ে পেছনের জানলাটা খুলে গেল, ঘরের ভেতর ঢুকল একটা মাতাল বাতাস, আর–
আর সমস্ত ঘরটার মধ্যে ধুলোর ঘূর্ণির একটা পাক দিয়ে সেই বাতাস দপ করে আলোটাকে নিবিয়ে দিলে। মনে হল খোলা জানলার পথে শ্ৰীমন্ত রায় আবার এসে ঘরে ঢুকেছে।
এতক্ষণে–এইবার ঘরফাটানো আর্ত একটা চিৎকার বেরুল নিতাইয়ের গলা দিয়ে। মুহূর্তে সমস্ত বাড়ি জেগে উঠল, হইচই করে লোক ছুটে এল।
.
পরের দিনটা তার কী ভাবে যে কাটল সেকথা ভগবানই বলতে পারেন।
গত রাত্রিতে এ কী ঘটল? এমন দুঃস্বপ্ন যে কখনও সম্ভব হতে পারে একথা কি সে কোনওদিন কল্পনাই করতে পেরেছিল নাকি? কিন্তু তবুও তো এ সম্ভব হল! স্বপ্ন মনে করে একে উড়িয়ে দেওয়া চলবে না, বুকের ওপরে হাতের লাল ছাপখানাই তার প্রমাণ।
কী করবে সে? কী উপায় তার? পালিয়ে যাবে? কিন্তু পালিয়েই বা লাভ কী? যার দেহ আছে তাকে ফাঁকি দেওয়া চলে, কিন্তু অশরীরীর দৃষ্টিকে অতিক্রম করবার কোনও উপায় নেই। যেখানেই যাও–ঠিক তোমাকে খুঁজে বার করবে, প্রতিশোধ নেবে। আকাশে বাতাসে প্রেতাত্মার আগুন-ভরা রাশি রাশি চোখ ভেসে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারের আড়ালে আড়ালে ঘুরছে তার হিংস্র থাবা, তার রক্তাক্ত নখর।
সমস্ত দিন সে অসুস্থের মতো ঘরের মধ্যে পড়ে রইল। কানের কাছে ক্রমাগত বাজছে রাত্রির সেই ভবিষ্যদ্বাণী–তিনদিন মাত্র সময়। তার একটা দিন তো কেটে গেল। তারপর আর একদিন কাটবে, তারপরে আরও একটা দিন। নিতাই কিছুই করতে পারে না। কোনও প্রতিকার করতে পারে না, শুধু একান্ত অসহায়ভাবে, একান্ত মুড়ের মতো একটা ভয়ঙ্কর বীভৎস পরিণামের জন্যে প্রতীক্ষা করে থাকবে।
উঃ, অসহ্য।
নিতাই যেন পাগল হয়ে যাবে। মাথার ভেতরে তার আগুনের একটা কুণ্ড যেন খাঁ-খাঁ করে জ্বলছে। অন্যায় করেছিল সে–এই তার শাস্তি। অন্যায় কখনও ঢাকা থাকবে না, পাপ কখনও চাপা থাকবে না। অনেক টাকার মালিক হয়েছে সেবড়লোক হয়েছে। কিন্তু শাস্তি কই? সুখ কোথায়? শুধু এক শ্ৰীমন্ত রায়কেই তো ছোরা মারেনি। যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে সে ধানচালের ব্লক মার্কেট করেছে। শুধু এক শ্ৰীমন্ত রায়ই নয়–দুর্ভিক্ষে যারা অনাহারে মরেছে, তারা সবাই কি এই সুযোগে তার ওপরে প্রতিশোধ। নিতে আসবে?
মর্মান্তিক যন্ত্রণায় আর-একটা দিন কেটে গেল। এইবারে ট্রেনের একখানা টিকিট কিনে সে দিল্লি-আগ্রা কোথাও চম্পট দেবে কি না ভাবছে, এমন সময় দারোগা সাহেব এসে উপস্থিত।
এত বন্ধুত্ব, এত খাতির, তবু নিতাইয়ের বুকটা হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠল। আচমকা মনে হল, যেন সে যে শ্ৰীমন্ত রায়কে খুন করেছে এ-খবরটা জানাজানি হয়ে গেছে পৃথিবীর সব
জায়গায়। আর সেই অপরাধে দারোগাসাহেব তাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন।
নিতাই চমকে উঠে দাঁড়াল। হাত থেকে হুঁকোটা ঠকাস করে পড়ে গেল মাটিতে। দারোগা হো-হো করে হেসে উঠলেন।
–তোমার হল কী সরকার? এমন আঁতকে উঠলে কেন?
নিজেকে সামলে নিয়ে নিতাই বললে, না, কিছু হয়নি তো?
–তবে অমন ভয় পেলে কেন?
–না–না–ভয় পাইনি। কিন্তু এই সাতসকালে অমন ধড়াচূড়া পরে কোথায় চললেন দারোগাসাহেব!
–শোনোনি কিছু? মানিকপুর স্টেশনে কাল রাত্রে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে গেছে যে!
নিতাইয়ের মাথার মধ্যে রক্ত চলকে গেল।
–কী হয়েছে মানিকপুরে?
–খুন! পয়েন্টসম্যানকে খুন করে দুজন ভদ্র ডাকাত স্টেশনের মেলব্যাগ লুট করতে চেয়েছিল। স্টেশনমাস্টার গণেশবাবুকেও তারা খুন করতে যাচ্ছিল–এমন সময় বাইরে থেকে কে পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে একজন ডাকাতকে আহত করে। ডাকাত দুটো পালিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, যে গুলি ছুঁড়ে ডাকাত তাড়াল, তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
–কী ভয়ানক!
–হ্যাঁ, ভয়ানক ব্যাপার বইকি! শুনে তো আমারই হাত-পা পেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে! আছি বাবা ধ্যাধ্যেড়ে গোবিন্দপুরের এক জঙ্গলের ভেতর পড়ে, এখানে ওসব বোমা-পিস্তলের কারবার কেন? সিধে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করুক, লাঠিপেটা করে দু-একটার মাথা ভাঙুক, গ্রামকে গ্রাম ধরে চালান করে দিই সদরে। কিন্তু এ সব কী রে বাপু।