–কোন্ চাবি? শিগগির বলে দাও আমাদের সময় নেই।
–ওই তো বড় পিতলেরটা।
এইবার হঠাৎ পিশাচের মতো হেসে উঠল বিরিঞ্চি। সেই হাসিতে অনাদিও যোগ দিলে–পাগলা শেয়ালের গোঙানির মতো সে টেনে টেনে হাসতে লাগল।
বিরিঞ্চি বললে, শোনো গোবর-গণেশ, তোমাকে আমরা খুন করব।
–কেন? গণেশবাবু শেষ চেষ্টায় নিজেকে সংযত করলেন। বিপদের সময় অতি বড় কাপুরুষের বুকেও সাহস জেগে ওঠে, গণেশবাবুরও তাই হল।
গণেশবাবু বললেন, আমি চাবি তো দিয়েছি।
–কিন্তু তুমি আমাদের মুখ চেনো।
–সে তো রহমান চেনে, রাম সিংও চেনে।
–সকলকেই সাবাড় করব–এবং আজ রাত্রেই করব।
যেটুকু শক্তি মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল, সেটুকু লোপ পেয়ে গেল নিঃশেষে। এরা খুনে, এরা ডাকাত! গণেশবাবু কেঁদে উঠলেন : টাকা নিয়ে যাও, আমাকে বাঁচাও!
আবার অনাদি আর বিরিঞ্চি তেমনি অমানুষিকভাবে হাসতে শুরু করলে।
–বাঁচাতে পারতুম, কিন্তু উপায় নেই। তা হলে আমরাই বিপদে পড়ব।
–তোমরা আমাকে মারবেই?
–নিশ্চয়! রেডি হও। ইচ্ছে হলে শেষবারের মতো ভগবানকেও ডেকে নিতে পারো।
গণেশবাবুর মনের সামনে ছবির মতো ভেসে গেল তাঁর কলকাতার বাড়ি। বুড়ি মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে। তারা যখন এই খবর পাবে–
শেষ চেষ্টায় গণেশবাবু বললেন, আমাকে বাঁচাও!
অনাদির হাতের পিস্তলটা কাঁপতে লাগল : অসম্ভব! ওয়ান—টু–
গণেশবাবু চোখ বুজলেন।
কিন্তু অনাদি থ্রি বলবার আগেই জানলা-পথে একটা বিদ্যুতের ঝলক। গুড়ুম করে পিস্তলের শব্দযন্ত্রণায় আর্তনাদ করে অনাদি বসে পড়ল। তারপর আরও শব্দ–আরও, আরও। ঝনঝন করে ঘরের আলোটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, একটা সীমাহীন অন্ধকারে প্লাবিত হয়ে গেল সমস্ত। বাইরে থেকে উকট হাসির তরঙ্গ উঠল : হাঃ—হাঃ—হাঃ—হাঃ–
অতিম চেষ্টায় প্রবল একটা চিৎকার করে গিরিধারীর রক্তাক্ত মৃতদেহের ওপরে গণেশবাবু মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন।
.
ছয়
বুকের ওপর গেঞ্জিটার গায়ে রক্তমাখা একটা হাতের ছাপ জ্বলজ্বল করছে।
নিতাই সরকার পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল খানিকক্ষণ। ভাববার বা কথা বলার শক্তি তার একেবারে লোপ পেয়ে গেছে। মাথার ভেতরে কী একটা চাকার মতো ঘুরছে প্রচণ্ড বেগে, কানের কাছে ভোমরার ডাকের মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে বোঁ-বোঁ করে শব্দ হচ্ছে। বাইরে বাতাসের গোঙানি চলেছে অশ্রান্তভাবে–যেন অশরীরী শ্ৰীমন্ত রায় আহত হয়ে আর্তনাদ করে উঠেছে। ঘরের ভেতরে ছোট আলোটা জ্বলছে, কোনও ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ একচক্ষু দানবের চোখ থেকে যেন হিংসার আগুন পিছলে পড়ছে।
কতক্ষণ কেটে গেছে নিতাইয়ের খেয়াল ছিল না। হঠাৎ একসময় সচেতন হয়ে সে আর্তনাদ করে উঠতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর ফুটল না–কে যেন তার জিভটাকে গলার ভিতর দিয়ে একেবারে সোজা পেটের মাঝখানে টেনে নিয়ে গেছে।
শ্ৰীমন্ত রায়। শ্ৰীমন্ত রায় সত্যিই মরেনি! না–না, তা কী করে সম্ভব। তার হাতের ছোরা তো ব্যর্থ হয়নি! মনে পড়ছে কাশী মিত্র ঘাটের পাশে সেই নির্জন গলি আর শূন্য পাটগুদাম। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রাত। স্ট্র্যান্ড রোড ঘুমিয়ে পড়েছে, গঙ্গার বুক থেকে কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না–শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে একটা মাতালের চিৎকার আর মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক। একটা পেটা ঘড়িতে রাত দুটো বাজল।
শুন্য পাটগুদামের নির্জন তেতলা। বিদ্যুতের বাতি নেই, শুধু একটা লণ্ঠন মিটমিট করছিল। ঘরে ছিল তারা দুজন। কেশবদাস মাগনিরামের গদি থেকে লুট করে আনা পনেরো হাজার টাকার নোটের তাড়াটা তাদের সামনেই পড়েছিল। আধাআধি ভাগ হবে। দুজনের চোখই লোভে জানোয়ারের মতো জ্বলছিল।
হঠাৎ নিতাই বলেছিল, ওই জানলাটা বন্ধ করে দাও ভাই শ্ৰীমন্ত। এত রাত্রে এখানে আলো দেখে কোনও ব্যাটা পুলিশ যদি
–ঠিক কথা।শ্ৰীমন্ত উঠে পড়েছিল, বন্ধ করতে গিয়েছিল জানলা।
আর এই মুহূর্তের জন্যেই অপেক্ষা করছিল নিতাই। বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে সে টেনে বার করেছিল একখানা ধারালো ছোরা, লণ্ঠনের আলোয় সেটা ক্ষুধার্ত বাঘের জিভের মতো লকলক করে উঠেছিল। শ্ৰীমন্ত তখনও পেছন ফিরে আছে, ঘাসের ভেতরে লুকিয়ে-থাকা বিষধর গোখরো সাপের মতো যে বিপদ তার দিকে এগিয়ে আসছে তা কল্পনাও করতে পারেনি। চোখের পলকে নিতাই হাতখানাকে ওপরে তুলেছিল, বাঘের জিভটায় লেগেছিল একটা তীব্র ঝলক, তারপরেই সেটা সবেগে গিয়ে বিধেছিল শ্ৰীমন্ত রায়ের পিঠে।
–বিশ্বাসঘাতক—
কথাটা সম্পূর্ণও বেরুতে পারেনি শ্ৰীমন্ত রায়ের মুখ দিয়ে। টলতে টলতে সে মাটিতে উবুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল, ফোয়ারার মতো খানিক রক্ত উছলে এসে নিতাইয়ের জামায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু নিতাই আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি। বিদ্যুতের মতো নোটের তাড়াটা পকেটে পুরে নিয়ে এবং ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজায় শিকল বন্ধ করে দিয়েছিল; পথে বেরিয়ে এসে সোজা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে গায়ের রক্তাক্ত জামাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল গঙ্গার খরধারার মধ্যে। তারপর–
তারপর আজ সেই শ্ৰীমন্ত রায় ফিরে এসেছে।
অশরীরী। ভূত! কে জানে? নিতাই কিছু ভাবতেও পারছে না, বুঝতেও পারছে না। ছয় মাস আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যার পর থেকে সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে মরবার পরেই শ্ৰীমন্ত রায় ফুরিয়ে যায়নি। দেহীই হোক আর অশীরীই হোক, সে যে নিতাইকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এ নিঃসন্দেহে সত্য, এবং একদিন সে যে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে, তাতেও কোনও সংশয় তার নেই।