মুখের ভেতরে দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠল বিরিঞ্চির। দুটো চোখ আগুনের দুটো গোলার মতো ধকধক করে জ্বলতে লাগল।
.
রাত অন্ধকার।
আকাশে মেঘ জমে আছে, তার তলায় ডুব দিয়ে তারাগুলো মিলিয়ে গেছে দৃষ্টির বাইরে। স্টেশনের আলোটা মিটমিট করে জ্বলছে, কিন্তু তাতে দুহাত দূরের অন্ধকারও আলো হয়ে উঠছে না। আর ওপারের ঢালু বিলের বুক থেকে তেমনি শনশন হাওয়া দিচ্ছে। সমস্ত পরিবেশটাই যেন কেমন অস্বস্তিকর আর অস্বাভাবিক।
একটু পরেই মেল ট্রেন আসবে। আশেপাশে দু-তিনটে পোস্ট-অফিস থেকে কতগুলো মেলব্যাগ এসে জমে আছে–সেগুলো তুলে দিয়ে নতুন ব্যাগ নামাতে হবে। রাতে আর রানার যাবে না, সেগুলো জমা থাকবে স্টেশনে–তারপর সকালে—
.
রহমান খেতে গেছে, বাইরে বসে আছে গিরিধারী। ঠিক কালকের রাতটার মতো। গণেশবাবু ভাবছিলেন, এই শান্ত নির্বিরোধ স্টেশনটায় এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কত কী ঘটে গেল। কালো হাত থেকে আরম্ভ করে গিরিধারীর এই দুর্গতি পর্যন্ত সবই একটা রহস্যের সূত্রে গাঁথা। গণেশবাবুর ভয় করছিল, কিন্তু সেইসঙ্গে এও মনে হচ্ছিল যে এর ভেতরে নিশ্চয় কোনও লোকের শয়তানি আছে।
বিশেষ করে বিরিঞ্চি আর অনাদিকে তাঁর এতটুকু ভালো লাগছে না। বললে, ওরা নাকি আই-বির লোক। কিন্তু ভাব-ভঙ্গি দেখে গণেশবাবুর কেমন সন্দেহ জাগছে। ওদের ভঙ্গি ঠিক ভালো লোকের মতো নয়–কেমন যেন–
গণেশবাবু থানায় খবর পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিরিঞ্চি তা হতে দেয়নি। বলছে যে, তাতে নাকি কাজের ক্ষতি হবে। কিন্তু পুলিশের লোকের কাজের কী ক্ষতি হবে তা গণেশবাবু বুঝতে পারলেন না। নাঃ–তিনি টেলিফোন করে সদর স্টেশনে খবর দেবেন, সেখান থেকে তারা যা খুশি করুক। শেষে একটা অঘটন ঘটলে তাঁর কাঁধের ওপর যে সমস্ত দায়িত্বটা এসে খাঁড়ার মতো নেমে পড়বে তা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। গোমেজের পাল্লায় পড়ে তাঁর সে-শিক্ষা হয়ে গেছে।
ঢং করে সাড়ে নটা বাজল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ওদিকে ঝনঝন করে সাড়া উঠল টেলিফোন থেকে। নটা চল্লিশে ডাক-গাড়ি আসবে, তারই সূচনা।
স্টেশনে যাত্রী বেশি নেই–যে-দু-চারজন আছে, তাদের আগেই টিকিট দেওয়া হয়ে গেছে। টেলিফোন ধরে খানিকক্ষণ সাঙ্কেতিক ভাষায় আলাপ করলেন গণেশবাবু। তারপর বললেন, ঘণ্টি লাগা গিরিধারী সিগন্যাল দে। গাড়ি আসছে।
ঠিক আছে হুজুর হাতের লাল-নীল লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে গিরিধারী সিগন্যাল দিতে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্ধকারের ভেতর থেকে উড়ে এল আলোকের ঝড়। ডাক-গাড়ি এসে দু মিনিটের জন্যে দম নিলে মানিকপুরে। খানিকক্ষণ হইচই, যাত্রীদের ওঠা-নামা। এর মধ্যেই মেলব্যাগ নামানো হয়ে গেল।
স্টেশন যখন আবার নিঃসাড় আর নিঝুম হয়ে গেল, তখন রাত দশটা। সাড়ে দশটা থেকে রহমানের ডিউটি। এই আধঘণ্টা সময়টুকু ভালোয় ভালোয় কেটে গেলে হয়। মেলব্যাগগুলো ছোট একটা ঘরের ভেতর বন্ধ করে ভালো করে তালা-চাবি দিয়ে গণেশবাবু চেয়ারে এসে বসলেন, তারপর বিড়ি ধরালেন একটা।
হঠাৎ মনে পড়ল, এখানকার ব্যাপারটা সদরে জানানো সরকার।
গণেশবাবু টেলিফোনটা তুলে নিলেন।
আর সেই মুহূর্তেই পিস্তলের শব্দে স্টেশনটা থরথর করে কেঁপে উঠল। গণেশবাবুর কাঁপা হাত থেকে রিসিভারটা ঠক করে টেবিলের ওপর পড়ে গেল।
টলতে টলতে ঘরের মধ্যে চলে এল গিরিধারী। ঘরের বড় আলোটায় গণেশবাবু যা দেখলেন তাতে তাঁর দম আটকে আসবার উপক্রম করল। গিরিধারীর বুকের বাঁ পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, তার নীল উর্দি লাল হয়ে গেছে রক্তে। এক হাতে ক্ষত-চিহ্নটাকে চেপে ধরে গিরিধারী মেঝের ওপরে পড়ে গেল।
অমানুষিক ভয়ে গণেশবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, গিরিধারী, এ কী! কিন্তু তাঁর কথাটাও শেষ হতে পেল না।
খোলা দরজার পথে দুটি মূর্তি এসে দেখা দিয়েছে। দুটি মূর্তি–পিশাচের মতো জ্বলছে তাদের চোখ। তাদের দুহাতে দুটি পিস্তল গণেশবাবুর বুক লক্ষ্য করে উদ্যত হয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তে তাঁকে গুলি করবে।
আর্তনাদ করে গণেশবাবু বললেন, বিরিঞ্চিবাবু, অনাদিবাবু! আপনারাই শেষে গিরিধারীকে–
-হ্যাঁ, আমরাই গিরিধারীকে খুন করেছি, দরকার হলে আপনাকেও খুন করব।বাঘের মতো চাপা গলায় হিংস্র গর্জন করে বিরিঞ্চি জবাব দিলে। গণেশবাবুর মুখ দিয়ে অব্যক্তভাবে বেরুল : কেন?
-চুপ, কোনও কথা নয়। তোমাকে মেরে আমাদের লাভ নেই। তোমরা দুজন ছিলে–আমাদের কাজের অসুবিধে হতে পারত, তাই একটাকে নিকেশ করে দিয়েছি।
দুটো উদ্যত রিভলবারের মুখে দাঁড়িয়ে ঘামে গণেশবাবুর সর্বাঙ্গ ভিজে যেতে লাগল। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড যেন পাথর হয়ে গেছে তাঁর।
–চাবি দাও শিগগির–অনাদি পাগলা শেয়ালের মতো খেঁকিয়ে উঠল।
–কিসের চাবি—
–যে-ঘরে ডাকের ব্যাগ রেখেছ সেই ঘরের।
গণেশবাবুর কথা কইবার শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। তিনি শুধু নিঃশব্দে আঙুল বাড়িয়ে টেবিলের ওপরকার চাবির গোছাটা দেখিয়ে দিলেন।
অনাদির পিস্তলটা তেমনি গণেশবাবুর দিকে মুখ করে আছে, বিরিঞ্চি একটা থাবা দিয়ে চাবিগুলো তুলে নিলে। আতঙ্ক-বিহ্বল আচ্ছন্ন দৃষ্টির সাহায্যে গণেশবাবু স্পষ্টই দেখতে পেলেন, বুনো জানোয়ারের ক্ষুধিত মুখের মতো একটা উগ্র লোভ বিরিঞ্চি আর অনাদির চোখে-মুখে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে।